রবিবাসরীয় সাহিত্যের অঙ্গনে - সন্দীপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের নতুন উপন্যাস  প্রথম বিদুর । একেবারে এক নতুন চিন্তা ধারার প্রতিফলন। সঙ্গে থাকবেন। 

       প্রথম বিদুর #৪

Image may contain: sky, outdoor, nature and water

সন্দীপ চক্রবর্তী

ভেবেছিলাম বিদুর বোধহয় আজ বৃন্দাবন দাসের সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু ও সারাদিন পুরনো মন্দিরে কাটিয়ে দিল। দুপুরে বেরনোর সময় বলল, 'তোর যাওয়ার দরকার নেই। তেমন কিছু হলে আমি তোকে ফোন করব।' আমি টুকাইয়ের ছড়া শুনলাম। বৌদির সঙ্গে গল্প করলাম। বিকেলে নতুন মন্দিরে গিয়ে দেখলাম বিদুর নারান ঠাকুরের স্ট্যাচুর সামনে বসে আছে৷
'কী রে কিছু পেলি?'
'হাওয়া কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারলাম না।'-- বিদুর অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল।
'হাওয়া! সে আবার কী?'
বিদুর কিছু বলল না। রাতে খাবার সময় আমি আর খোকনদা কথা বলে গেলাম। বিদুর চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ল।
ভূতের মতো একলা সিগারেট টেনে আমি শুয়ে পড়লাম। বিদুর তখনও বারান্দায়। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। মাঝরাতে বাথরুমে যাব বলে আলো জ্বেলে দেখি বিদুরের বিছানা খালি। বাথরুমেও নেই। কোথায় গেল এত রাতে? ফোন করতে গিয়ে চোখে পড়ল ওর বালিশের পাশে পড়ে।
আধঘন্টা পর যখন আমি খোকনদাকে খবর দেব কিনা ভাবছি, বিদুর গদাইলশকরি চালে ঘরে ঢুকে বলল, 'পাঁচ মিনিট আগে যেতে পারলে লোকদুটোকে ধরতে পারতাম। একটুর জন্য ফসকে গেল।'
কারা ফসকে গেল কিছুই বুঝলাম না। আমার ভ্যাবাচ্যাকা মূর্তি দেখে বিদুর ঘটনাটা খুলে বলল। আমি শুয়ে পড়ার পর বিদুর বারান্দায় পায়েচারি করছিল। তখনই ও লোকদুটোকে দেখে। গঙ্গাধরপুর রোড গড়াইয়ের পাড় ছুঁয়ে ডানদিকে বেঁকে গেছে। রাস্তায় আলো আছে। এ বাড়ির বারান্দা থেকে রাস্তাটা স্পষ্ট দেখা যায়। লোকদুটো ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার ধারের ব্যারিকেড টপকে পাড়ে নেমে যায়। বিদুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গড়াইয়ের পাড়ে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু ওদের দেখতে পায়নি।
'ওরা কোথায় যেতে পারে কিছু বুঝতে পারলি?'
বিদুর হাসল, 'সেটা বুঝলে তো সেখানে চলেই যেতাম। ওদের হাতে টর্চ ছিল। গড়াইয়ের খাত ধরে ওরা যদি দূরে কোথাও যেত তা হলে টর্চের আলো দেখে আমি ট্রেস করে ফেলতাম। ওরা কাছাকাছি কোথাও শেলটার নিয়েছে।'
'কী করে বুঝলি?'
'রাস্তা থেকে পাড়ে নেমে বাঁদিকে কিছুটা হাঁটলেই ডাকাতে কালীর ঘাট। আমি কাল গিয়ে দেখে এসেছি। ইন ফ্যাক্ট, আমি কাল ফেরার সময় পাড় দিয়ে হেঁটে এসেই রাস্তায় উঠেছিলাম। লোকদুটো যদি ঘাটের সিঁড়িতে বসে থাকে তা হলে রাস্তা থেকে ওদের আমি দেখতে পাব না।'
'তা হলে ওরা নির্ঘাত পুরনো মন্দিরে গেছে।'
'হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন যাবে? যেহেতু আমরা পুরনো মন্দিরে দিশি মদের বোতল পেয়েছি, তাই যদি ধরে নিই নেশাভাং করাটাই উদ্দেশ্য, তা হলে আমি বলব মাঝরাতে অত বড়ো ব্যাগ নিয়ে কেউ ওসব করতে যায় না।'
অকাট্য যুক্তি। চুপ করে গেলাম। বিদুর বলল, 'আমার অনুমান ওরা কোনও ক্রিমিনাল অ্যাক্টের সঙ্গে জড়িত। তাই ওদের খোঁজখবর নেওয়াটা জরুরি।'
অবাক হয়ে বললাম, ' যাচ্চলে! তুই তো ইতিহাসের মিসিং লিঙ্ক খুঁজছিস। তাতে এই লোকদুটো এত ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে উঠছে কেন?'
বিদুর হাই তুলে বলল, 'খুব ঘুম পাচ্ছে অমিত। চল শুয়ে পড়া যাক।'
বুঝলাম আর কিছু বলবে না। অগত্যা আমিও শুয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। তাতে অবশ্য ক্ষতি কিছু নেই। আজও আমি কোথাও বেরোব না। বিদুর যা পারে করুক। কোনও মন্দিরেই আমার আর দেখার কিছু নেই।
দিনটা বিশুদ্ধ আলসেমি করে কেটে গেল। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আরাম করে সিগারেট টানছি, বিদুর বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চোখ রেখে বলল, 'আজ কিন্তু তোকে রাত জাগতে হবে অমিত।'
'খামোখা রাত জাগতে যাব কেন?'
'কারণ, লোকদুটো আজও এদিকে আসছে। হাতে কালকের সেই ব্যাগটা। সুতরাং আমাদের এখনই বেরোতে হবে।'
ঘুম মাথায় উঠল। বিদুর নৈশ অভিযানে যেতে বলছে মানে কিছু ঘটার সম্ভাবনা আছে। আগেও দু'একবার দেখেছি।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা সোজা ব্যারিকেডের ধারে চলে গেলাম। লোকদুটো তখনও দূরে। গাছগাছালির আড়ালে। আমাদের দেখতে পাবে না।
একজায়গায় ব্যারিকেডটা একটু ভাঙা। বিদুর বলল, 'কাল রাতে ওরা এখান দিয়েই পাড়ে নেমেছিল। সেটাই সুবিধাজনক। নয়তো ব্যারিকেডের ওপর উঠে লাফ দিতে হবে। ব্যাগটা ভারী হলে তা সম্ভব নয়। আজ ওদের আগে আমাদের নামতে হবে।'
বিদুর নেমে গেল। দেখাদেখি আমিও। চাঁদনি রাত। গড়াইয়ের খাল হিরের নেকলেসের মতো জ্বলছে। বাঁদিক ঘুরে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল ডাকাতে কালীর ঘাট।
'তুই কি শিয়োর, ওরা এখানেই আসবে?'
'এখানে আসবে কিনা জানি না, তবে আমার অনুমান এদিকে আসবে।'
ঘাটটা একটু খাড়া ধরনের। ধাপগুলো চওড়া আর উঁচু। অনেকটা বেনারসের মতো। আমরা একদম ওপরের ধাপে উঠে দু'দিকে ঘাপটি মেরে বসলাম।
বিদুরের অনুমান অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। লোকদুটো এদিকেই এল। কিন্তু ঘাটে না উঠে সোজা চলে গেল। অর্থাৎ ঘাটের বাঁদিকে। মানেটা সহজ। পুরনো মন্দির ওদের গন্তব্য নয়।
বেড়ালের মতো নিঃশব্দে বিদুর নীচের ধাপে নেমে গেল। পিছনে আমি। উপুড় হয়ে শুয়ে কুমিরের মতো গলা বাড়িয়ে দেখছিলাম। এখান থেকে দেখতে অসুবিধে হয় না। লোকদুটো গড়াইয়ের খাত যেখানে শেষ হয়েছে সেখানকার কংক্রিটের দেওয়ালের সামনে দাঁড়াল। আগের দিনই দেখেছিলাম এদিকের দেওয়ালের সবটাই বট-অশ্বত্থের ঝুরিতে ঢাকা। ঝুরির নীচে কিছু থাকতে পারে ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। কিন্তু লোকদুটো দেওয়ালের ঠিক মাঝখানে আলগা ঝুরিগুলো সরাতেই চোখে পড়ল বিশাল একটা গর্ত। প্রমাণ সাইজের একজন মানুষও ওই গর্তে অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে।
রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় বললাম, 'ওটা কী বিদুর?'
বিদুর ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, 'কথা বলিস না। চুপচাপ দেখে যা।'
দু'জনের মধ্যে একজন ব্যাগ নিয়ে গর্তের মধ্যে চলে গেল। অন্যজন রইল পাহারায়।
বিদুর বোধহয় এই সুযোগটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে ঘাট থেকে নেমে ও এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। তারপর পিছন থেকে জাপটে ধরে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল লোকটার হাতদুটো। বিদুরের নিয়মিত জিম করা শরীর। ওর শক্তির সঙ্গে যোঝা সহজ কথা নয়।
'এবার বলো তো বাছাধন তোমরা কে? কী করতে রোজ এখানে আসো?'
'তা নিয়ে আপনার কী দরকার?'
'আমরা পুলিশের লোক। লালবাজার থেকে আসছি। কথার উত্তর না দিলে এখানেই পুঁতে দিয়ে যাব।'
ভেবেছিলাম লোকটা বোধহয় আবার তেড়িয়া হয়ে কিছু বলবে। কিন্তু লালবাজারের নাম শুনে বেশ মুষড়ে পড়ল। --- 'আমি কিছু জানি না স্যার। সব শিবেনদা জানে।'
'শিবেনদা কে?'
লোকটা যা বলল তা এইরকম-- শিবেন পাল দিশি মদের কারবার করে। নস্করপাড়ায় তার ঠেক আছে। কিন্তু পুলিশ ঝামেলা করে বলে বিক্রি না হওয়া মাল ও এই গর্তে রেখে যায়। এটা তার গোডাউন বলা যায়। গ্রামের লোকেরা গর্তের কথা জানে না বলে কোনও সমস্যা হয় না।
পুরনো মন্দিরের সেই দিশি মদের বোতলের কথা মনে পড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, 'তোমরা তার মানে পুরনো মন্দিরেও যাও? '
'না স্যার, ওখানে আমরা যাই না৷ গেলে মা কুপিত হন। তবে শিবেনদা যায়। মাল-ফাল খায়। ফুর্তি করে।'
যে লোকটা গর্তের ভেতরে গিয়েছিল সে এইসময় ফিরে এল। বিদুর তৈরি ছিল। ওকেও মাটিতে ফেলে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। তারপর আমাকে বলল, 'তুই এদের কাছে থাক। আমি আসছি।'
আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই বিদুর ক্যাঙারুর মতো লাফ দিয়ে গর্তে ঢুকে গেল। আমার সামনে লোকদুটো হাতবাঁধা অবস্থায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে। নিতান্তই নিরীহ চেহারা। অসামাজিক কাজ করে বলে চোখেমুখে কৃত্রিম কাঠিন্য ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু লালবাজারের অফিসারদের সামনে ট্যাঁ ফোঁ করার মুরোদ নেই। তাই নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট ধরালাম।
বিদুর ফিরল প্রায় কুড়ি মিনিট পর। দেখে মনে হল বেশ চিন্তিত। লোকদুটো হাঁ করে ওকে দেখছিল। বিদুর বলল, 'আজ তোমাদের ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ফের যদি এখানে দেখি তো সাত বছরের জন্য ঢুকিয়ে দেব।'
ছাড়া পেয়ে লোকদুটো দৌড়ে পালাল।
আমার তর সইছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম, 'গর্তের মধ্যে কিছু পেলি?'
'রহস্য আরও বেড়ে গেল রে অমিত! ওটা যে সাধারণ গর্ত নয় সেটা আমি বাইরে থেকে দেখেই বুঝেছিলাম। গর্তের মুখে পাড়ের গাঁথুনি একদম সার্কুলার। অর্থাৎ গর্ত আগেই ছিল। দেওয়াল গাঁথা হয়েছে পরে, গর্ত বাঁচিয়ে। এখন ভেতরে ঢুকে বুঝলাম ওটা একটা সুড়ঙ্গ।'
'মাই গুডনেস! কী বলছিস তুই?'
'ইয়েস। কিছুদূর যাওয়ার পর সুড়ঙ্গটা খাড়া হয়ে ওপরে উঠেছে। লেন্থ আন্দাজ তিরিশ-চল্লিশ ফুট। কিন্তু রহস্যটা অন্য জায়গায়। যে কোনও সুড়ঙ্গের দুটো মুখ থাকে। এটির ওদিকের মুখটি বন্ধ। প্রশ্ন হল, প্রথম থেকেই বন্ধ ছিল নাকি ধ্বস-টস নেমে বন্ধ হয়েছে?'
'খোকনদা জানতে পারে।'
'মনে হয় না। শুনলি না লোকটা বলল গ্রামের কেউ এই গর্তের কথা জানে না।'
ফিরে চললাম। তিনটে বেজে গেছে। চারিদিকে আধিভৌতিক শূন্যতা। হয়তো এরই মধ্যে কোথাও বিদুরের প্রশ্নের উত্তর আছে। সময় হলেই জানতে পারা যাবে। অথবা কোনওদিনই জানা যাবে না।
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ