দিন প্রতিদিন বিশেষ - বিজ্ঞানের হাতেই পরাস্ত করোনা

 


 বিজ্ঞানই দেখালো মুক্তির পথ




কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা,  ১৭ জানুয়ারি 

অলক্ষ্যে থাকা সেই গবেষকদের উদ্দেশ্যে অন্তত একবার নতমস্তক হন।
ভুলে যান আপনার জাতপাত, রাজনৈতিক আনুগত্য।
কৃতজ্ঞতা জানান কোনও ব্যক্তিগত উচ্চাশা ছাড়াই, গবেষণাগারে নীরবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়া বিজ্ঞান সাধকদের। যাঁরা মাত্র কয়েক মসের মধ্যেই করোনার মারণাস্ত্র তুলে দিলেন মানবজাতির হাতে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশ্ব ইতিহাসে আরও একবার মেধার স্বাক্ষর রাখলেন ভারতের গবেষক, প্রযুক্তিবিদরা।

শনিবার। শুরু হয়ে গেলো একশো ছত্রিশ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়া মানুষের ভারতে, করোনা টিকা দেওয়ার কর্মযজ্ঞ। হায়দরাবাদের ভারত বায়োটেকে ভারতীয় গবেষকদের তৈরি 'কোভ্যাকসিন', আর পুনের সেরাম ইনস্টিটিউটে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির 'কোভিশিল্ড' দিয়ে শুরু হলো করোনা রাহুমুক্তির অভিযান। রাজনীতি যা পারে না, সেই অসাধ্যসাধন বারেবারে করে দেখান বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদরা। মাত্র একটি আবিষ্কার, একটি প্রযুক্তির বাঁধনে গোটা বিশ্বকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক মঞ্চে।



রাজনীতিবিদরা যে কাজটাই করেন, তা করেন ঢাকঢোল পিটিয়ে। ভুল হয় না গণ্ডায় গণ্ডায় পরিসংখ্যান টেনে তার ফিরিস্তি দেওয়াতেও। বিজ্ঞান সাধকরা সততই নীরব। আপনমনে তাঁরা নিজের কাজটা করে যান। গবেষণাগারের চার দেওয়ালের মধ্যে রাহুমুক্তির উপায় খুঁজে বেড়ান বিশ্ব সমুদায়ের মঙ্গলে। গবেষকদের কাজে গতির ডানা জুড়ে দিতে, নিঃশর্ত মদতের হাত বাড়িয়ে দেন প্রযুক্তিবিদরা। গবেষণাগারের সেই অভেদ্য দেওয়াল টপকে সেখানে পৌঁছয় না প্রচারের আলো। যে কাজটি করতে কমপক্ষে পাঁচ সাত বছর লাগার কথা, আজ সেই ফসলটাই আমরা ঘরে তুললাম বছর ঘোরার আগেই। দুর্ভাগ্য, সেখানেও ঢুকে পড়ে রাজনীতির কূটকচালি। রোগ প্রতিষেধকের গায়ে লাগে রাজনীতির রং। গবেষকরা প্রতিষেধক তৈরি করেন, আর সেই প্রতিষেধক নিয়ে একের পর আর এক প্রশ্ন তুলে যান রাজনীতির স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞরা।



শনিবার ভারতে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেলো অতিমারী কোভিড ১৯ মোকাবিলা অভিযানের। রাশিয়ায় অবশ্য এই অভিযান শুরু হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরেই। এরপর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রতিষেধক দেওয়ার কাজ শুরু হয় ইংল্যান্ড, আমেরিকায়। মাসের শেষ দিকে একই পথে হাঁটে দুনিয়ার কমপক্ষে আরও তেতাল্লিশটি দেশ। আর নতুন বছরের গোড়াতেই 'বিশ্ব করোনা যুদ্ধে' নেমে পড়লো ভারত।

প্রতিষেধক হাতিয়ার করে মহামারীর সঙ্গে লড়াইয়ের ইতিহাস এমনকিছু পুরনো নয়। তার বয়স মাত্র দুশো উন্নিশ বছর। সাল ১৭৯৬। বিশ্ব সমুদায়ের হাতে প্রথম ভ্যাকসিনটি তুলে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ চিকিৎসক এডোয়ার্ড জেনার। উদ্দেশ্য গুটিবসন্তর মহামারী রুখে দেওয়া। সেই ভ্যাকসিন ভারতে পৌঁছেছিল তার চারবছর পর, ১৮০২ সালে। প্রতিষেধকের প্রথম ডোজটি নিয়েছিলেন তৎকালীন বোম্বের এক তরুণী এনা ডাস্টহল।

এবার শুরু হলো ফের এক নতুন অধ্যায়। আবার এক করোনাতঙ্ক মুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখানো শুরু করলো কোভ্যাকসিন, কোভিশিল্ড। সারা দেশের মোট তিন হাজার ছটি কেন্দ্রে প্রথম দফায় দেশে টিকা নিলেন এক লক্ষ একানব্বই হাজার একশো একাশিজন প্রথম সারীর করোনাযোদ্ধা। তাঁরা সবাই নিশ্চয়ই নীরবে কৃতজ্ঞতা জানালেন মানবজাতিকে নিউ নর্মাল জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার কারিগরদের। একমাত্র বিজ্ঞানই পারে। ভারতের গবেষক, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদরাও পারেন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে মাত্র কয়েক মাসেই ভারতে করোনা মোকাবিলার টিকা আবিষ্কার, বাস্তবে চিকিৎসা গবেষণার ইতিহাসে এক নতুন চমক। আর এই চমক যাঁরা দিলেন তাঁদের আগেও দেখেননি, ভবিষ্যতেও দেখবেন না। তবে তাঁদের অস্তিত্ব আগেও টের পেয়েছেন, এবারেও পেলেন। মড়ক থেকে মানবজাতিকে বাঁচাতে গবেষকরা তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে হাতে তুলে দিলেন প্রতিষেধক। মানুষের সমস্যামুক্তির মুশকিল আসান যে আসলে বিজ্ঞানের হাতে, আরও একবার তা প্রমাণ হলো।

"আমি সুস্থ আছি।" কলকাতার সরকারি সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল এসএসকেএম থেকে বাংলার মানুষকে অভয়বার্তা দিলেন কলকাতার বিদায়ী মেয়র ফিরহাদ হাকিম। শনিবার সকালে ভ্যাকসিন উৎসবের খোশমেজাজে মেয়র বললেন, "আরও এনার্জি বেড়ে গেছে।" খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই, ভ্যাকসিনের ট্রায়াল রানের সময়েই টিকা নিয়েছিলেন ফিরহাদ।


আসলে নতুন সবকিছুর মধ্যেই এক উত্তেজনা, কৌতুহলের সঙ্গে আড়ালে আবডালে লুকানো থাকে খানিকটা ভয়। দুশো বছরেরও আগে একই ছবি দেখা গেছিলো ভারতে গুটিবসন্তের টিকা নিয়ে। মানুষের ভয় কাটাতে সেই ভ্যাকসিন নিতে এগিয়ে এসেছিলেন শাসক, চিকিৎসক, সমাজের বিশিষ্ট শ্রেণির পরিবাররা। ১৯৯৫ সালের পালস পোলিও টিকাকরনের সময়েও দেখা গেছিলো একই ছবি। সেই আতঙ্ক আর সন্দেহের বাতাবরন ফিরে আসতে দেখা গেলো করোনা ভ্যাকসিনের বেলাতেও। 
এই ঘটনা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, আজও বিজ্ঞানের ভিত ভারতে নড়বড়ে। দেশবাসীকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা আজও সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানের আবিষ্কার নিয়ে সাধারণ মানুষের এই অযথা সন্দেহ, আর ভয়ের জায়গাটা উসকে দিয়েই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে নেমে পড়েন রাজনিতীর কারবারীরা।

করোনা টিকা নিয়েও জড়িয়ে গেছিলো জাতপাত, রাজনীতি। জীবনদায়ী এই টিকার গায়ে দেগে দেওয়া হয়েছিল মোদি টিকার সীলমোহর। "আরে ছাড়ুন, আমি ওই বিজেপির ভ্যাকসিন নেবো না," সরাসরি বলে বসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বাজিমাতের টোপ, আমরা ক্ষমতায় এলে বিনি পয়সায় ওই টিকা দেবো। তবে অখিলেশকেও ছাড়িয়ে গেছিলেন তাঁর দলেরই এক এমএলসি, আশুতোষ সিনহা। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েই খোলাখুলি তাঁর সন্দেহের কথা বলেন, "হতে পারে, এই ভ্যাকসিন নপুংসক করে দেবে!"
কম যায়নি কংগ্রেসও। কোভ্যাকসিন, কোভিশিল্ড নিয়ে আগুন ঝরিয়েছেন দলের নেতারাও। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের আশ্বাসে কর্ণপাত না করেই, বারেবারে সন্দেহপ্রকাশ করেছেন টিকার বিশ্বস্ততা নিয়ে। গোটা ব্যাপারটাকেই মোদি সরকারের চমক বলে চালানোর চেষ্টা চলে।


বরং বাংলার ছবিটা যেন উল্টো। আতঙ্কতো দূরের কথা, এখানে বিতর্ক বাঁধলো রাজনিতীবিদদের টিকা নেওয়ার ঘটনায়। সারা দেশে টিকাকরণ নির্বিঘ্নে হলেও, হাতেগোনা কয়েকজনের অসুস্থ হওয়ার খবর মিলেছে। চিকিৎসকরা দেখছেন ওই অসুস্থতার সঙ্গে প্রতিষেধকের কোনও সম্পর্ক আছে কিনা। ওদিকে গবেষকরা কোনও রাখঢাক না করেই জানিয়েছেন, জরুরিকালীন অবস্থা সামাল দিতেই ব্যাপক হারে ভ্যাকসিনের থার্ড স্টেজ ট্রায়ালের জন্য অপেক্ষা করা হয়নি। তবে আগের দুটি ট্রায়ালের ফলাফল নিখুঁত বলেই বিশেষজ্ঞরা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

রাজনৈতিক বিরোধিতা ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে সমাজবাদী পার্টি, কংগ্রেসের সক্রিয়তাতেই তার প্রমাণ। ইতিমধ্যেই দেশে করোনার বলি হয়েছেন এক লক্ষ বাহান্ন হাজার মানুষ। প্রতিষেধকে আস্থা রেখে সেই আতঙ্ক যখন কাটতে বসেছে, ঠিক তখনই অন্য আর এক সন্দেহের আতঙ্ক সংক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিলো রাজনীতির মানুষজনের তোলা প্রশ্নে। তবে শনিবার টিকাকরণের প্রথম দিনের ছবিটা ছিলো একেবারেই উল্টো সুরে বাঁধা। সন্দেহমুক্ত হয়েই দেশের করোনাযোদ্ধারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। টিকা নিয়েছেন। সতর্ক চিকিৎসকরা নজর রেখে চলেছিলেন গোটা প্রক্রিয়ার ওপরে। প্রথম দফার টিকাকরণে লক্ষ্য তিন কোটি স্বাস্থ্যকর্মী। আঠাশ দিনের ফারাকে আসবে দ্বিতীয় ডোজ। তখন লক্ষ্য হবে তিরিশ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া। শনিবার করোনা টিকাকরণের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে আবেগে ভাসলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। 

ভারতে তৈরি 'কোভ্যাকসিন'কেও ছেড়ে কথা বলেননি বিজেপি বিরোধী শিবির। নিজেদের ভ্যাকসিন বিরোধিতাকে যুক্তিসিদ্ধ করতে টেনে আনেন বিদেশের সংবাদমাধ্যমের বক্তব্য। দেশ জুড়ে গুজব ছড়িয়েছিলো 'পালস পোলিও' ভ্যাকসিন নিয়েও। গুজবের কারিগর ছিলেন রাজনীতি আর কিছু ধর্মের অভিভাবকরা। তবে সেসবের মুখে কালি দিয়ে, শেষ পর্যন্ত রোগমুক্তির রাস্তাতেই পা বাড়িয়েছিল ভারত। ১৯৭৭ সালে গুটিবসন্ত মুক্ত, আর ২০১৪ সালে ভারতকে পোলিয়ো মুক্ত ঘোষনা করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। শনিবার সেই ধারাবাহিকতায় নাম লেখালো আর এক মুক্তি অভিযান- করোনামুক্ত ভারত অভিযান। 
( ছবি সৌজন্যঃ সংবাদ মাধ্যম)








মন্তব্যসমূহ