রবিবাসরীয় বিশেষ নিবন্ধ - কাজল ভট্টাচার্য

   ।। চশমা ছাড়াই বিশ্বরূপ দর্শন ।।


(চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। কবিগুরুর কথা। সেই আলোয় টান পড়লেই চশমা। কবি অন্য আর এক দেখার কথাও বলেছিলেন। সে দেখা অন্তর দিয়ে। তাতে চশমা লাগে না। তবে আমরা যাই দেখি না কেন, চোখ দিয়ে দেখলেও তা দেখি অন্তরের রংয়ে রাঙিয়েই।)

কাজল ভট্টাচার্য

গান্ধারি কাপড় দিয়ে চোখ ঢাকতেন। আমি ঢেকেছিলাম চশমা দিয়ে। দুজনেই কিন্তু চেয়েছিলাম দুনিয়াটাকে দেখতে। তবে দুজন দুভাবে। নিজেদের মতো করে।

গান্ধারি অন্তর দিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। আমি পাওয়ার লেন্স দিয়ে। মন থেকে দৃষ্টি যখন শরীরে আসে তখনই তৈরি হয় নানা জটিলতা। মনের গায়ে পড়ে অভিজ্ঞতার আস্তরণ। আর সময়ের শ্যাওলা জমে চোখের লেন্সে। সেই শ্যাওলা ভেদ করে দুনিয়াটাকে দেখতেই লেন্স। দিনে দিনে শ্যাওলা পুরু হয়, রং বদলায়। বদলে নিতে হয় চশমার লেন্সের পাওয়ার। সাদাকে সাদা দেখা, কালোকে কালো। চেনার চেষ্টা প্রজাপতির পাখার রং।

#পূর্বকথা...


বছর দেড় দুই আগের কথা। এক সুন্দর সকালে আবিষ্কার করেছিলাম, পেপারের ছোট অক্ষর পড়তে অসুবিধা হচ্ছে। তখন পাত্তা দিইনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এড়িয়েও যেতে পারিনি। গেলাম ডাক্তারের কাছে। এবিসিডি'র পড়া ধরে, চশমা ধরিয়ে দিলেন। দূরদৃষ্টি ঠিকঠাক। সামনের মুখগুলোই ঠিকঠাক চিনতে ভুল হচ্ছিল। ডাক্তারবাবু অভয় দিলেন, "এবার আর চিনতে ভুল হবে না। এগিয়ে যান।"

এগোতে গিয়েই বিপদ।
ডাক্তারবাবুর দোতলার চেম্বার থেকে বেরিয়ে, সিঁড়িতে পা রাখতেই সব যেন ওলোটপালোট। ধাপে ঠিকঠাকভাবে পা পড়লো না। চট করে রেলিং ধরে অধঃপতন সামাল দিয়েছিলাম। গোটা সিঁড়িটাই যেন দুলে উঠেছিলো। চোখে নতুন চশমা। চশমাটা খুলে সিঁড়ির দিকে তাকালাম। সবকিছুই ঠিকঠাক। কী হলো ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম। রিসিপশন কাউন্টারে বসা সুন্দরী বলেছিল। "নতুন চশমাতো, তাই অসুবিধা হচ্ছে।" তারপরেই অভয়বাণী, "পাওয়ারটা দু একদিনেই সেট হয়ে যাবে। তারপর আর অসুবিধা হবে না দেখবেন।"

চশমার সেই শুরু। সুন্দরীদের কথাতেও যে ভরসা করা যায়, সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম। পরেরদিনই অসুবিধাটা কমে এসছিলো। বোঝাপড়া হয়ে গেছিলো চোখ আর লেন্সের। রাস্তাঘাট, সিঁড়ির সঙ্গে দিব্য নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল ঠুলি আঁটা আঁখি। 
তবে প্রশ্নটা থেকেই গেছিলো, কে কার সঙ্গে আপোষরফাটা করলো? সুন্দরী বলেছিল, পাওয়ারটা দু একদিনেই সেট হয়ে যাবে। কিন্তু ফাইবার গ্লাসের লেন্স চোখের সঙ্গে সেট করবে কি করে? ওটাতো নির্জীব এক লেন্সমাত্র। অনুভূতিহীন এক বিশেষ আকৃতির, ফিজিক্সের পরিভাষায় দুখণ্ড উত্তল অথবা অবতল কাচের টুকরো বিশেষ। ওর ক্ষমতা ছিলো নাকি সেট করার? 

#চোখের রকমসকম...


রইলো বাকী চোখ। ভীষন অনুভূতিপ্রবণ এক অঙ্গ। সেখানেও জৈবিক এক লেন্স আছে বটে। অক্ষিকোটরে সুরক্ষিত। ভীষন সংবেদনশীল। বেশি আলো দেখলেই বুজে আসে। আবার রহস্য খুঁজে পেলেই পিটপিট করে। ভয় পেলেই গোলগোল, ছানাবড়া হয়ে যায়। 
চোখ অনুভূতিপ্রবণও। ভালবাসার মুখ দেখলেই দৃষ্টি স্থির। ভালবাসার আনন্দে আবার বিদায়েও ছলছল করে ওঠে চোখ। কবি গান বাঁধেন- নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে! চোখের কোল বেয়ে জল গড়ায়। আবার সেই চোখেই জল শুকিয়েও যায়। তাহলে কি সেই চোখই লেন্সের সঙ্গে 'সেট' করে নিয়েছিলো? 

এই চোখের আবার ভাষাও আছে। রসিকজন তার সন্ধান পায়। প্রেমিক তা পড়ে ফেলে। কবিরা সেই চোখের বন্দনা করে। জনারণ্যের শোরগোলেও দিব্য কথা হয়ে যায় চার চোখের। আবার যখন মুখ তার ভাষা হারায়, কথা বলে ওঠে চোখ। শব্দহীন সে কথা সবাই শুনতে পায় না। ভাসাভাসা চোখের কোল থেকে সেই ভাষা ঝরে পড়ে, গভীর রাতে এক অচেনা তারার খসে পড়ার মতো। যে দেখার সে দেখে। বাকীরা নিদ্রা যায়। 

টলটলে দুই চোখে ছায়া পড়ে মনের কোটরে লুকিয়ে রাখা আবেগের। রাগ ঝরে পড়ে চোখের ভাষায়। স্থির চোখের দৃষ্টির সামনে বেশিক্ষণ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না যার মনে চোর আছে। এহেন চোখ দুর্বল হয়ে ঢাকা পড়লো চশমায়।

#প্রোগ্রেসিভ লেন্স...


সেই শুরু। কিছুদিন যেতে না যেতেই ফের গড়বড়। কেমন যেন ঝাপসা লুক। সব চরিত্রের আনাগোনা যেন কুয়াশা গায়ে মেখে। চোখে উঠলো বাইফোকাল। কিন্তু তাতেও সমস্যা পুরোপুরী মিটলো না। বড্ড ছোট্ট ওই লেন্স ঢাকা দৃষ্টির পরিসর। গোটা একটা ক্যানভাসও ধরা পড়তো না। ছবি আঁকতে গেলেই একরাশ বিরক্তি। মাথাটা উঠিয়ে নামিয়ে ডান পাশ বাঁপাশ করে দেখতে হতো। বিরক্তিকর। অতএব চক্ষু বিশেষজ্ঞের রায়, প্রোগ্রেসিভ লেন্স নিন। 
অগত্যা, আরও একবার পরীক্ষা দিতে বসে পড়া। "চোখের পাওয়ার খানিকটা বেড়েছে"। ডাক্তারবাবুর ঘোষনা। বেশ খুশি খুশি লাগছিল, চোখের পাওয়ারটা বেড়েছে শুনে। ঠিক কতটা বেড়েছে? সেই ভেরোনিকা সেইডার মতো নাকি? চোখের কী সাঙ্ঘাতিক পাওয়ার ছিলো পশ্চিম জার্মানির সেই সুন্দরীর। 

সালটা ছিলো ১৯৭৭। ছাব্বিশের ভেরোনিকা তখন স্টুটগার্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। আচমকাই একদিন সবাই আবিষ্কার করলো, কেউ যা দেখতে পায় না, তা ভেরোনিকা পায়। এমনকি দেড় কিলোমিটার দূরের জিনিসকেও মোটামুটি নিখুঁতভাবে দেখতে পেতো ভেরোনিকা। চিনে ফেলতে পারতো মানুষের মুখ। ক্ষমতা বাড়িয়ে আমার চোখও সেরকম কিছু হতে চলেছে ভেবেই স্নায়ুর চাপ বেড়ে গেলো।

বেশ ডগমগ হয়ে ডাক্তারবাবুকে বললাম, "তাহলে এবার চশমা থেকে মুক্তি?"
- কেন, চোখের পাওয়ার বেড়েছে বললাম তো!
- হ্যাঁ তাইতো। চোখের পাওয়ার বেড়ে গেলে আর চশমা কেন?
ডাক্তারবাবু এমনভাবে তাকালেন যেন এক দোপেয়ে উজবুক দেখছেন। দুচোখ ভর্তি তাচ্ছিল্য। আর আমার দুচোখ ভরা জিজ্ঞাসা। হলোটা কী? এবার ধীরগলায় ডাক্তারবাবু জানালেন, চোখের পাওয়ার বেড়েছে। চশমার পাওয়ার বাড়াতে হবে। ফের মনের ভেতর পাক খেয়ে চললো আর এক প্রশ্ন- চোখের পাওয়ার কমা মানেতো, দৃষ্টিশক্তি কমা। সেটাকে ম্যানেজ করতেই চশমা। চোখের পাওয়ার যতো কমবে, চশমার পাওয়ার ততো বাড়বে। চোখ আর চশমার সম্পর্কটা বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যস্তানুপাতিক। এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই চোখের অলঙ্কার হলো প্রোগ্রেসিভ লেন্স। 

উচ্চবর্ণের আধুনিক লেন্সের সঙ্গে কিছুতেই ভাব জমে না মধ্যবিত্তের কমপক্ষে পঞ্চাশ বছরের পুরনো চোখের। রাস্তাঘাট থেকে নিয়ে ল্যাম্পপোস্ট সবকিছুই কেমন আজগুবি। মানুষজনের মুখের দিকে তাকাতেও ভয় লাগে। কেমন যেন সবকিছুই বড্ড বেশি সাজানো গোছানো। এমনকি মোবাইলের স্ক্রিনটাও বাড়াবাড়ি রকমের উজ্জ্বল। সেইসব অস্বস্তি নিয়েই ঘোরাঘুরি চললো। 

#চশমা বিচ্ছেদ...


তারপর একদিন হঠাতই ঘটে গেলো সেই ঘটনাটা। অফিস টাইমের মেট্রো থেকে নামার সময় আমিও একটু বেতালা হয়ে গেছিলাম। কার যেন হাতের ধাক্কায় ছিটকে গেলো চশমাটা। আমাকে কিছু খুঁজতে দেখে দু চারজন পাবলিক এগিয়ে এলো। একজন বললো, "দেখুনতো লাইনে পড়ে থাকা চশমাটাই কি আপনার?"
এক মেট্রোকর্মীকে বলতেই জানিয়ে দিলেন, "এখন কিছু করা যাবে না।"

মনটা খারাপ হলো। চশমা চোখের বোঝাপড়াটা না হলেও, কয়েকটা দিনতো একসঙ্গে কাটলো। অকাল বিচ্ছেদ। ধীর পায়ে এগোলাম। রাস্তা পেরনোর সময় আজ একটু বেশিই সাবধান হলাম। একবারের বদলে দুবার ডানদিক বাঁদিক দেখলাম। গাড়ির আলোগুলো ঠিক গোল, চৌকো কোনটাই নয়। সবগুলোই যেন আলোর ছটা ছড়াচ্ছিলো। মানুষের মুখগুলো কেমন আবছা। 
"কাকা সাইডে!" রিক্সাওয়ালার কথায় সাবধান হয়ে গেলাম। কুয়াশার একটা ফিনফিনে ওড়নায় যেন সবকিছু ঢাকা। গলি মহল্লা গাড়িঘোড়া মানুষজন। সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি। তবে সবকিছুতেই যেন একটা রহস্য জড়িয়ে থাকা। আগের সেই পরিচিত অগোছালো দুনিয়া।

#সবারই একটা চশমা থাকে...




আসলে সবারই একটা চশমা থাকে। ফারাক একটাই। অনেক চশমা দেখা যায়, অনেক চশমা দেখা যায় না। আবার অনেক সময় সেই সূক্ষ্মদেহী চশমার ব্যাপারটা অন্যের চোখে পড়ে। কিন্তু যার চোখে ওই চশমা এঁটে বসেছে, তিনি নিজে টের পান না। কতোই না রং সেই সব চশমার। চোখ ঢাকা পড়ে চশমার আড়ালে। সবাই চশমা চোখেই পড়েন তা নয়। মনের চোখেও চশমা ঝুলিয়ে রাখেন অনেকেই। আবার চশমার চশমখোরিও চোখে পড়ে।

#সুন্দরদর্শন...



এইতো বেশ আছি। ভোটের বাজার সরগরম। কলির কুরুক্ষেত্র। নিয়ম করে টিভি'র 'ঘণ্টাখানেক' শুনছি। গলা শুনে অনেককেই চিনতেও পারছি। ওই গান্ধারির মতো। মনের পর্দায় জুম ইন করছে একেকটা মুখ। চোখে জুম আউট। ঠিক করলাম, আর চোখে লেন্স আঁটবো না।
লেন্স আঁটলেই যেন কুরুক্ষেত্রের ময়দানে বসে কৃষ্ণের মুখগহ্বরে বিশ্বরূপ দর্শন। ভেরোনিকা হয়ে দরকার নেই আমার। এই খালিচোখেই বেশ আছি। একটু ঝাপসাই থাকুক না মুখগুলো। কুয়াশায় মাখা সামনেরজন। সব পাহাড়ই তো দূর থেকে সুন্দর। সেই সুন্দরদর্শনেই ব্যস্ত থাকুক চোখ। প্রতিটা দর্শনকেই নাহয় মনের রংয়ে চুবিয়ে নেবো। 

দুনিয়াটাকে দেখবো মনের রংয়ে, সাদা চোখেই।

ক্যানভাসঃ সংগৃহীত

মন্তব্যসমূহ