রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সন্দীপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক উপন্যাস

 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের নতুন উপন্যাস  প্রথম বিদুর । একেবারে এক নতুন চিন্তা ধারার প্রতিফলন। সঙ্গে থাকবেন। 

প্রথম বিদুর#৫


সন্দীপ চক্রবর্তী
'সুড়ঙ্গ! গড়াইয়ের পাড়ে! এসব তুই কী বলছিস বিদুর?'
কাল রাতের বিবরণ শুনে খোকনদা একেবারে হাঁ হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ নিয়ে বসেছি। বাড়িতে বানানো কচুরি আর চা খেতে খেতে কথাবার্তা হচ্ছে৷
বিদুর বলল, 'হ্যাঁ খোকনদা, আমরা কাল দেখে এসেছি। সুড়ঙ্গটার একটা মুখ খোলা, অন্যটা বন্ধ। প্রবলেম সেটাই। কারণ বিপদের সময় পালানোর জন্যই লোকে সুড়ঙ্গ বানায়। কিন্তু একটা মুখ বন্ধ থাকলে সে যুক্তি টেঁকে না।'
'ওই লোকদুটো কিছু বলতে পারল না?' খোকনদার ইঙ্গিত শিবেনের চ্যালাদের দিকে।
'নেসেসিটি ইজ দা মাদার অব ইনভেনশন--কথাটা জানো তো? ওদের উদ্দেশ্য মদের বোতলগুলো নিরাপদে রাখা। সেটা সুড়ঙ্গের দশ হাত দূরত্বের মধ্যে রাখলেও চলে। ওরা এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন?'
মীমাংসাসূত্র বেরোল না। আমার মনে হল বিদুর বোধহয় অসম্ভবের পিছনে ধাওয়া করছে। আড়াইশো বছর আগে সেই ভয়ংকর রাতে মন্দিরের ভেতর জল কীভাবে ঢুকেছিল আজ আর জানা সম্ভব নয়। শেষপর্যন্ত আমাদের হয়তো হতাশ হয়েই কলকাতা ফিরে যেতে হবে।
বিদুর হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'আচ্ছা খোকনদা, পুরনো মন্দিরে গুপ্তধন কোথায় থাকত, তোমার কোনও ধারণা আছে?'
খোকনদা হেসে বলল, 'না রে। শুধু আমি কেন, গঙ্গাধরপুরের কারোরই নেই। তোর কী মনে হয়, গুপ্তধনের সঙ্গে সুড়ঙ্গের সম্পর্ক আছে?'
'ইতিহাস তো তাই বলছে। যেসব মন্দিরে গুপ্তধন থাকত, সেখানেই সুড়ঙ্গ কাটার রেওয়াজ ছিল। যাতে ডাকাত-ফাকাত পড়লে গুপ্তধন নিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়।'
'ডাকাতদের মন্দিরে কীভাবে ডাকাত পড়বে?-- এবার আমি প্রশ্ন করলাম।
'ভুলে যাস না অমিত এখান থেকে সমুদ্রের দূরত্ব মাত্র দশ কিলোমিটার। সেসময় আরাকান থেকে মগেরা এসে প্রায়ই লুটপাট করত। একটা গ্রাম্য ডাকাতদলের পক্ষে মগেদের মতো অর্গানাইজড লুটেরাদের মোকাবিলা করা সম্ভব কি?'
খোকনদা বলল, 'আমি তো বলছি তুই একবার বৃন্দাবনকাকার সঙ্গে দেখা কর। উনি অনেককিছুর খবর রাখেন। কবে যাবি বল, আমি নিয়ে যাব'
ঠিক হল আজ সন্ধ্যেবেলায় যাওয়া হবে। ওই সময় বৃন্দাবন দাস আহ্নিক করে বৈঠকখানায় কিছুক্ষণ বসেন। অন্য সময় শোবার ঘর থেকে বড়ো একটা বেরোন না। বাতে প্রায় পঙ্গু। বেশি নড়াচড়া করতে পারেন না।
খোকনদা বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরে এসে সিগারেট ধরালাম। বিদুর একটা মোটা ডায়েরিতে কীসব লিখছে। টুকাইয়ের গলা শুনতে পাচ্ছি। সম্ভবত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছড়া কাটছে। আমি লক্ষ করেছি খোকনদা বাড়িতে না থাকলে ওর ছড়া কাটার মাত্রা বেড়ে যায়।
বিদুর হঠাৎ ডায়েরি বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে গেল। শুনতে পেলাম টুকাইকে বলছে, 'ছড়াটা আর একবার বলো তো সোনা।'
টুকাই বলতে লাগল--
'কালীঠাকুর কালীঠাকুর
নদী কোথায় বলো
কালীঠাকুর বলেন হেসে
পাতলদেশে চলো
চারটে ছাগল আসছে ছুটে
ঘাসের গন্ধ শুঁকে
নদীর বুকে ঘাস গজালো
ছাগল খাবে সুখে।'
একই ছড়া বারতিনেক শুনে বিদুর যখন ঘরে এল তখন তার চেহারা পালটে গেছে৷ চাপা খুশিতে চকচক করছে চোখ। ঠোঁটের কোণে হাসি। আমি অবাক হয়ে বললাম, 'কী রে হাসছিস কেন?'
'আমি একটা আস্ত ইডিয়ট রে অমিত। হাতের কাছে সব সাজানো অথচ আমি দেখতে পাইনি।'
আমার বেশ রাগ হয়ে গেল, 'কী বলতে চাস, স্পষ্ট করে বল। বারবার হেঁয়ালি আমার ভালো লাগে না।'
'হেঁয়ালি নয় রে। টুকাইয়ের ছড়ার মধ্যে নারান ঠাকুরের পুরো গল্পটাই ধরা রয়েছে। এমনকী, সুড়ঙ্গের সঙ্গে যে মন্দিরের যোগ আছে ইঙ্গিত দেওয়া আছে তারও।'
কথাটা বিশ্বাস করতে পারলাম না। যে ঘটনা নিয়ে গঙ্গাধরপুরে এত গোপনীয়তা, একটা ছেলেভুলনো ছড়ায় তার কথা বলে দিলে তো তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
আমার যুক্তি শুনে বিদুর বলল, 'সেইখানেই তো ছড়া লেখকের কৃতিত্ব। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। হয়তো তার আশা ছিল কেউ না কেউ একদিন ছড়ার অর্থ বুঝতে পারবে।'
'বেশ, তোর ব্যাখ্যাটা আগে শুনি--'
'ছড়ায় জানতে চাওয়া হচ্ছে, নদী কোথায়? কালীঠাকুর বলছেন পাতালদেশে। পাতাল অর্থাৎ মাটির নীচে। অথচ নদী মাটির নীচে থাকে না। এখানেই এসে যাচ্ছে সুড়ঙ্গের কথা। তারপর ধর চারটে ছাগল। বিরাজনারায়ণ চারজন লেঠেল পাঠিয়েছিল। ব্যঙ্গ করে তাদের ছাগলের প্রতীকে দেখানো হয়েছে। পার্বতী অথবা গুপ্তধন এখানে ঘাস। ঘাসের সঙ্গে ছাগলের খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। এখানেও সেই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সব শেষে নদীর বুকে ঘাস গজানোর প্রসঙ্গ। নদীর বুকে ঘাস গজায় না। তা হলে চারটে ছাগল ঘাস খেতে কোথায় গেল?'
বিদুরের ব্যাখ্যা শুনে আমার রোমকূপ খাড়া হয়ে গেল। ওর প্রশ্নের উত্তর দেব কী, কথাই বলতে পারলাম না।
'মন্দিরের ভেতর ঢুকে পড়া জলে ডুবে চার লেঠেলই মারা গিয়েছিল অমিত। পরে চারটে বডি গড়াইয়ের জলেই ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ছড়ার শেষ লাইন, নদীর বুকে ঘাস গজালো/ছাগল খাবে সুখে-- সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।'
'কিন্তু মন্দিরে জল ঢুকল কীভাবে?'
'সুড়ঙ্গ দিয়ে। মন্দিরের সঙ্গে সুড়ঙ্গের কানেকশন আমরা এখনও পাইনি বটে, কিন্তু আমার অনুমান পেয়ে যাব।'
'আর নারান ঠাকুরের কী হল?'
'ছড়ায় যখন তার উল্লেখ নেই, ধরে নিতে হবে তিনি জীবিতই ছিলেন। সম্ভবত বিরাজনারায়ণের কোপদৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য ওকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেওয়া হয়।'
আমি আরও কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বিদুর বলল, 'আর কোনও কথা নয় অমিত। মনে আছে তো, সন্ধ্যেবেলায় বৃন্দাবন দাসের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। তার আগে দুপুরে আমরা একবার পুরনো মন্দিরে যাব।'
একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। জড়িয়ে পড়লাম অষ্টাদশ শতাব্দীর এক রহস্যে। বিদুর অনেকটাই রহস্যভেদ করে ফেলেছে। বাকিটাও নিশ্চয়ই পারবে। ছড়ার মানে জানার পর আমার আর কোনও সংশয় নেই৷
দুপুরবেলায় বিদুরের সঙ্গে পুরনো মন্দিরে হাজির হলাম। কিন্তু সুড়ঙ্গের মুখ খোঁজার পরিবর্তে ও বেদীর ওপর বসে সিগারেট ধরাল। আমি অবাক হয়ে বললাম, 'কী রে! ওইভাবে বসে থাকলে কাজ হবে?'
বিদুর অন্যমনস্ক, 'সুড়ঙ্গটা কোথায় থাকতে পারে বলে তোর মনে হয়?'
'সম্ভবত মেঝের নীচে।'
'তা হলে তো লেঠেলরা মন্দিরে ঢোকার আগে মেঝে খুঁড়ে রাখতে হয়। আর লেঠেলরা ঢুকে যদি দেখে মেঝে খোঁড়া তা হলে কি ওদের সন্দেহ হবে না?'
বিদুরের যুক্তি অস্বীকার করতে পারলাম না। দ্বিতীয় কোনও সম্ভাবনার কথাও মাথায় এল না। অগত্যা চুপ করে থাকাই শ্রেয়। বিদুর বলল, 'সুড়ঙ্গের মুখ এমন জায়গায় আছে যার কথা কেউ ভাবতেই পারবে না। কিন্তু প্রয়োজনে সেই মুখ সহজেই খুলে ফেলা যাবে।'
'হ্যাঁ, কিন্তু সেরকম জায়গা এই মন্দিরে কোথায়?'
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিদুর পকেট থেকে একটা ছোট ব্যাগ বের করল। ওই ব্যাগে ছুরি কাঁচি ম্যাগনিফাইং গ্লাস ইত্যাদি থাকে। বিদুর ম্যাগনিফাইং গ্লাসে চোখ রেখে বেদীর সামনে পিছনে দুই ধারে কী যেন দেখতে শুরু করল।
ওর উদ্দেশ্য বিধেয় কিছুই না বুঝতে পেরে বললাম, 'ওটা আবার কী শুরু করলি!'
'হাওয়া কোথা থেকে আসছে তাই দেখছি।'
হাওয়ার কথা বিদুরের মুখে আগেও একবার শুনেছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, 'দুটো দরজার একটারও পাল্লা নেই। জানলার অবস্থাও একইরকম। হাওয়া কোথা দিয়ে আসছে এরপরও বুঝতে পারছিস না?'
বিদুর আমার কথার কোনও জবাব দিল না। মিনিট পাঁচেক পর ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'দ্যাখ তো তুই কিছু দেখতে পাস কি না।'
গ্লাসে চোখ লাগালাম। বেদীর উচ্চতা চার ফুট মতো। ওপর থেকে আড়াই ফুট নীচে একটা সরু ফাটল চোখে পড়ল। ফাটলটা একটুও না বেঁকে বেদীর সামনে থেকে দুই ধার দিয়ে পিছনে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। কারণ এরকম জ্যামিতির নিয়ম মেনে ফাটল ধরে না।
'কী বুঝলি?' বিদুর জিজ্ঞাসা করল৷
'ফাটল বলেই তো মনে হচ্ছে।'
'তার মানে কিছুই বুঝিসনি।'
অস্বীকার করব না, বুঝতে পারিনি। তবে বিদুর বোধহয় কিছু একটা অনুমান করেছে। দেখলাম ছুরি দিয়ে চেঁছে ও বেদীর ওপরের চুনসুরকির আস্তরণের অনেকখানি তুলে ফেলল। লালচে রঙের আভাস পাওয়া মাত্র বুঝলাম ইট বেরিয়ে পড়েছে।
সবচেয়ে অবাক করা কাণ্ডটা ঘটল এরপর। বিদুর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ওই আড়াই ফুট নীচের ফাটলের ওপর হাত রেখে তুলে ফেলতে চাইল বেদীটা। একচুলও নড়াতে পারল না।
অবাক হয়ে বললাম, 'তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?'
বিদুরের মুখে কুলুপ। বারদুয়েক চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে ও ফোন করল খোকনদাকে,'তিন-
চারজন শক্তিশালী লোককে নিয়ে এখনই একবার পুরনো মন্দিরে চলে এস।---- না, ফোনে নয়। এখানে এস তারপর বলব।'
ফোন রেখে বিদুর আবার গম্ভীর। চোখ বেদীর ওপর। মাঝে মাঝে বেদীর ইটে আঙুল ঘষে কীসের যেন গন্ধ শুঁকছে। একটু আগে হলে এসব হয়তো আমার পাগলামি বলে মনে হত। কিন্তু রহস্যভেদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে না গেলে বিদুর খোকনদাকে ফোন করে আসতে বলত না। তবে শক্তিশালী লোকের কেন প্রয়োজন সেটা এখনও বুঝতে পারিনি। বেদীর নীচেই যদি সুড়ঙ্গের মুখ থাকে তা হলে তো ওটা ভেঙে ফেললেই হয়।
খোকনদা এল প্রায় আধঘন্টা পরে। সঙ্গে তিনটে পালোয়ান গোছের লোক। বিদুর তখন ছুরি দিয়ে চেঁছে সরু ফাটলটা চওড়া করার চেষ্টা করছে। খোকনদা বলল, 'বেদী কি ভাঙতে হবে বিদুর?'
'না। শুধু একটা আড়াই ফুট মোটা লোহার প্লেট সরাতে হবে।'
'লোহার প্লেট! কী বলছিস তুই? এটা তো বেদী।'
'হ্যাঁ বেদী। কিন্তু ওপরে রয়েছে একটা লোহার প্লেট। বেদীর ওপর থেকে আড়াই ফুট নীচে একটা সরু রেখা দেখে আমার সন্দেহ হয়। অমিত ভেবেছে ওটা ফাটল। আসলে ওটা ইটের গাঁথনি আর লোহার প্লেটের জোড়। প্লেটটা সরালেই তোমরা বুঝতে পারবে।'
তিনজন তিনদিকে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল। তারপর প্রায় আধঘন্টার চেষ্টায় লোহার প্লেটকে স্থানচ্যুত করা সম্ভব হল।
বিস্ফারিত চোখে দেখলাম বেদীর নীচে সুড়ঙ্গের দ্বিতীয় মুখ। প্রবল বেগে ধেয়ে আসা হাওয়ার ধাক্কা খেয়ে বোঝা গেল মন্দির থেকে সুড়ঙ্গ গিয়ে শেষ হয়েছে গড়াইয়ের পাড়ে।
বিদুর বলল, 'এই সেই সুড়ঙ্গ খোকনদা। এখান দিয়েই মন্দিরে জল ঢুকেছিল।'
খোকনদা বলল, 'কিন্তু বিদুর গড়াইয়ের জোয়ারের জল তো নাবালের চড়া পেরিয়ে ওপরে উঠত না।'
'জানি। ওই একটি প্রশ্নের উত্তরই আমার এখনও জানা বাকি। আশা করছি বৃন্দাবন দাস এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।'
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ