মহারাজের এই যুদ্ধটা একটু অন্য রকম , ২০২০ র যুদ্ধ সেও ছিল অন্যরকম

 ।। মহারাজা শুনছেন ।।




 কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ৩ ডিসেম্বর 

পৃথিবীর ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেলো টুয়েনটি- টুয়েনটি।

দুহাজার কুড়ির ক্যালেন্ডারটা ডাস্টবিনে ফেলেই, অনেকে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। আপদ বিদায়। কিন্তু একী? দুহাজার একুশের ইনিংস শুরু হতেই ফের এক বড় ঝটকা। বছর শুরুর প্রথম শনিবারের গায়ে ঢ্যারা পড়লো অপয়া দিনের।

নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন। গোটা বাংলার হৃদয়ের গতি বাড়িয়ে দিলো একটি খবর। আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন বাংলার মুকুটহীন মহারাজ। সৌরভ গাঙ্গুলি। সামান্য কয়েক মুহূর্তের জন্য তাল কেটে গেছিল হৃদয়ের। তারপরেই ফের বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো। চিকিৎসকদের পরিচর্যায় বিপদ কাটলো মহারাজের। ঠিক যেভাবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে বিপদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলেছেন চিকিৎসকরা। বছরশেষের দিন পর্যন্ত, তাঁরা নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের আট কোটি ন'লক্ষ উনচল্লিশ হাজার আটশো তিনজন করোনা আক্রান্তকে। বাংলাতেও এই সংখ্যাটা নেহাত মন্দ ছিলো না। পাঁচ লক্ষ একত্রিশ হাজার আটশো বাষট্টি।


"তোদের চৈতন্য হোক!" বারেবারে বলেছিলেন কল্পতরুর ঠাকুর। তা কে শোনে কার কথা? চৈতন্যহীন ডালির ফুলেই ঠাকুরকে অর্ঘ নিবেদন করে গেছে বাঙালি। তারপরেই ছুটেছে পার্ক স্ট্রিটে। নিউ ইয়ারের আনন্দ জোয়ারে শরীর ভাসাতে। তার আগে বড়দিনের ছোটরাতেও উত্তেজনার আগুনে জ্বলে উঠেছিল মহানগর। 

ঠাকুরের কথা কানে তোলেনি মানুষ। পাত্তা দেয়নি চিকিৎসকের পরামর্শকেও। বড়ো দুর্বল স্মৃতিশক্তি মানুষের। নাকি দাম্ভিকতা? গত বছরের বিদায়বেলা পর্যন্ত বিশ্বের একশো নব্বইটিরও বেশি দেশে করোনা রোগির সংখ্যা ছিলো আট কোটি সাতাশ লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার তিনশো চব্বিশ। আর ভারতে সেই সংখ্যাটা এক কোটি দুলক্ষ ছেষট্টি হাজার ছশো চুয়াত্তর। চিকিৎসায় করোনাকে হারিয়ে বাড়ি ফিরেছেন আটানব্বই লক্ষ ষাট হাজার দুশো আশিজন মানুষ। আর যাঁরা বাড়ি ফিরতে পারলেন না, তাঁদের সংখ্যাটাও কম নয়। রোগের বলি হয়েছেন এক লক্ষ আটচল্লিশ হাজার সাতশো আটত্রিশজন।

আমাদের রাজ্যের অবস্থাও একসময় সঙ্গীন হয়েছিল। গত শনিবার পর্যন্ত রোগের বলি হয়েছেন ন'হাজার সাতশো আটত্রিশজন। এরপরেও চৈতন্য ফেরাতো দূরের কথা, সম্বিতও ফেরেনি। ওদিকে ইতিমধ্যেই শক্তি বাড়িয়ে ফিরে এসছে করোনা। সুতরাং সাধু সাবধান।

কতোই না শৌর্য বীর্যের ইতিহাস মানবজাতির। জল স্থল আকাশ ছাড়িয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জয়ের উন্মাদনা। গোটা পৃথিবীটাকেই দখলে নেওয়ার স্বপ্ন শাসকের দুচোখে। সেই প্রবল পরাক্রমশালী বিশ্ব সমুদায়কে একেবারে ঘর ঢুকিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো এক অদৃশ্য আতঙ্ক। মানুষ সেই আতঙ্ককে চিনলো 'কোভিড ১৯' নামে।


সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাইক্রোস্কোপিক ভাইরাস ঘাড় ধরে দেখিয়ে দিলো, কত সহজে বাঁচা যায়। কত আড়ম্বরহীন ভাবে চলতে পারে জীবন। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে নিজের এক ছোট্ট জগত। মল মাল্টিপেক্স ছাড়া আজও পাড়ার মুদি দোকান থেকেই দিব্য জোগাড় করে নেওয়া যেতে পারে জীবনের একান্ত প্রয়োজনীয় রসদ। 
ঢাকঢোল বাজিয়ে ওয়ার্লড সামিট, জি ফাইভ, আশিয়ান দেশগুলির তর্কাতর্কি, বৈঠক সম্মেলন সব ফালতু। এত কথা খরচ করে যা হয়নি, বিনা বাক্যব্যয়েই তা করে দেখিয়ে দিলো করোনা। 

চাপে পড়লে বাপ। লক ডাউনের এক ধাক্কাতেই কাত দুনিয়া। বিনা আয়াসেই পৃথিবী ফিরে পেয়েছিলো, তার সেই ঝকঝকে তকতকে পরিবেশ। প্লেনের কানফাটানো আওয়াজে শান্তিভঙ্গ হতো না ধ্যানস্থ আকাশের। ধোঁয়ার কলঙ্কের দাগ পড়তো না তার ঘন নীল গায়ে। মুক্ত দূষনহীন বায়ুমণ্ডল। একলাফে অনেকখানি বেড়ে গেছিলো দৃষ্টিশক্তির পরিসর। নাকতলার ফ্ল্যাটের ছাদে বসেই চোখে পড়তো আকাশচুম্বী সাউথ সিটির গর্বোদ্ধত চূড়া। কলকাতার বাতাস থেকে ধুলোর আস্তরণ সরতেই, দেখা দিয়েছিলো তিলোত্তমাকে। হাওড়া কলকাতার গঙ্গার জলও যে পূণ্যতোয়া হতে পারে তা দেখিয়ে দিয়ে গেলো লকডাউন। বদলে গেছিলো যেন নদীর রং রূপ। গঙ্গার বুক চিরে ফেরি চলাচল বন্ধ। সারাদিন শুধু জলের ছলাত ছলাত। নদীর সঙ্গে কতোই না কথা ঘাটবাঁধানো সিঁড়ির। 

মহানগরীর বুকে বসেও বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। দেখিয়ে দিয়ে গেলো ২০২০। আসলে বিশ্ব এখন ওই টুয়েনটি টুয়েনটির ভাষাই বোঝে। পাঁচদিনের টেস্ট, ওয়ান ডে সব চুলোয় গেছে। অতো সময় নেই মানুষের। দরকার উত্তেজনার আগুনে টগবগে জীবন। তাই মানুষের ভাষাতেই মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল কোভিড। টুয়েনটি টুয়েনটির গতিতেই ব্যাটিং, বোলিং করে গেছিলো কোভিড- ১৯। 

গতবছরের সেই মার্চ থেকে প্রায় অগাস্ট মাস পর্যন্ত, ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে ছিলো মানুষ। আর সেই সুযোগে নিজেদের পৃথিবীটাকে দেখতে, বন জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে এসছিল চারপেয়েরা। কয়েকটা মাস নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়িয়েছে জঙ্গল কেটে সাফ করে মানুষের তৈরি এক্সপ্রেস ওয়েতে। দেখতে এসেছিল তাদের হারিয়ে যাওয়া দেশ, বনভূমিকে। আজ যেমন কাঁটাতারের বেড়ার আড়াল থেকে এপারের মানুষ দেখে ওপারে ফেলে আসা ভিটেমাটিকে। কোভিড ওই বন্যপ্রাণীগুলোর হাতে সেই বেড়া ডিঙানোর পাসপোর্ট ভিসা তুলে দিয়েছিল নিঃশর্তে।

ক্রমেই দূরত্ব বেড়ে চলেছিল মানুষ থেকে মানুষের। কখনও দেশ, জাতধর্ম, আবার কখনও রাজনীতির নামে। আশির দশকের শুরুতেই বাংলা ব্যান্ড 'মহীনের ঘোড়াগুলি'র শিল্পীরা শুনিয়েছিলেন,
"..তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে..."
সেই কলির গায়েই সীলমোহর দেগে দিয়ে গেলো কোভিড। সেই সঙ্গে দিয়ে গেলো ভার্চুয়াল দুনিয়ার প্রথম পাঠ। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, হাইটেক ভার্চুয়াল দুনিয়ার স্তব্ধতা।
প্রাণহীন যন্ত্রসভ্যতার থেকে থেকে সরে আসুক বিশ্ব। দূরত্ব কমুক তোমার আমার। মানবিকতার সেই পাঠ যতদিন না রপ্ত হয়, ততদিন লজ্জায় মুখ ঢাকা থাকুক মানবজাতির।

ক্যালেন্ডার পাল্টালো। মাসগুলো কিন্তু সেই একই। বারগুলোও বদলায়নি। পাল্টালো শুধু বার তারিখের জুটি। এরকমই এক জুটি ছিলো শচীন সৌরভের। ক্রিকেট মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার পরে আজও একইরকম উষ্ণতায় বাঁধা সেই জুটি। চিকিৎসদের অভয়বাণী, এক মাস পরেই মাঠে নামবেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ব্যাট হাতে আরও একবার তেড়ে আসুন বাংলার মহারাজ। বিদায় করুন পৃথিবীর যা কিছু অশুভ। তিনিই পারেন। গায়ে গা লাগিয়ে আমরা বাংলার মহারাজাকে দেখি আর শিখি। দৃঢ় হোক মানুষের সঙ্গে মানুষের জুটি।

মন্তব্যসমূহ