রবিবাসরীয় সাহিত্যের অঙ্গনে - কাজল ভট্টাচার্যের বিশেষ নিবন্ধ

 ।। টুরু লভের কেমিস্ট্রি ।।



(প্রেম স্বর্গীয়। প্রেম বোঝাপড়া। প্রেম নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই। প্রেম আজ টুরু লভ। আর সেই লভ, স্বর্গীয় না, বোঝাপড়াও না। টুরু কিনা, তাতেও সন্দেহ। গবেষকরা বলছেন, প্রেম এক বিশুদ্ধ কেমিস্ট্রি। রসায়নের দুষ্টুমি।)


        কাজল ভট্টাচার্য



 আহা উহু


"গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালবেসেছি !"

আহা, কী দরাজ গলা। পৌরুষ যেন উপচে পড়ছে গানের গমকে। কিন্তু সে যখন সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন সে যদি হয় 'রাজা' নাটকের কদাকার সেই রাজা।

চমকে গেলেন তো? স্বপ্ন ভেঙে চৌচির। 

পত্রপাঠ বিদায় না। প্রত্যাখান না। আরও একবার ভেবে দেখবেন। কদাকার হলেও রাজা তো! ট্যাকের জোর আছে। যাকে কেউ উলঙ্গ বলার স্পর্ধা দেখায় না। ওসব মেধা ফেধা, গানের গলা মাথায় উঠলো। রাজা মানেই রাজকীয়, রাজপ্রাসাদ। বৈভব। প্রতিপত্তি। ক্ষমতা। ট্যাঁকের জোরেই বাজিমাত।


সে যদি হয় নারী?

যার কোকিলকন্ঠে, 'প্রেম একবার এসেছিল নীরবে' শুনে আপনি 'জিঙা লা লা' হয়ে গেছিলেন।

এবার সে সামনে এসে দাঁড়ালো। এক সাদামাটা, চমক- দমকহীন মহিলা। অস্থিচর্মসার এক নারী। যার গলায় আপনি ওপরের ওই গানের কলি শুনে প্রেমে পড়ে গেছিলেন। এই মুহূর্তে হাত বাড়ালেই সে। কিন্তু হাত তখন অচল। নিস্পন্দ। ড্যাবডেবে দুচোখ তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে নারীশরীরের পরম রমনীয় চড়াই উতরাই। 


 প্রেমের আমি প্রেমের তুমি






মুখে যতই হাতি ঘোড়া মারুন না কেন- প্রেম স্বর্গীয় ! প্রেমে শরীর গৌণ। প্রেম দেহাতীত। সব কথার কথা। আসল কথা বেশ মনমতো একখানা নধর শরীর চাই। আবার একেকজনের প্রেফারেন্স একেক রকম। পুরুষ হোক বা নারী, সবারই নিজের নিজের পছন্দ আছে। 'আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী ! 


অনেকেই আবার আজকাল বুক বাজিয়ে ফেসবুকে স্টেটাস মারেন- আমি স্যাপিয়োসেক্সুয়াল। মেধাতেই প্রেম। 'নোপ' টু শরীর। এবার ওপরের ওই গান "অল্প অল্প ভালবেসেছি" গেয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। কী দেখলেন? 'স্যাপিয়ো' গায়েব। আয়নার বুকে ধরা 'সেক্সুয়াল' এর ছবি।

'ভিঁগে হোঁঠ তেরে। পিয়াসা দিল মেরা ।"


আয়নার সামনে



নিজেকে চিনলেই মুশকিল। নিজের কাছে নিজের ধরা পড়ে যাওয়া। 

স্যাপিয়োসেক্সুয়ালের মধ্যেও আধ্যাত্মিকতা লুকিয়ে আছে। প্লেটোনিক প্রেম দুই মানব শরীরের। ঈশ্বর- ভক্তি, যুগল প্রেমের মতোই। এপ্রেম বিরল প্রজাতির।


'নরেন যেদিন নিজেকে চিনতে পারবে, সেদিন আর দেহ রাখবে না।' হ্যাঁ এতটাই মুশকিল নিজেকে চিনতে পারা। নরনারায়ণ। সেই স্বরূপ চিনতে পেরে দেহ রাখা যায় না। মন তখন দেহাতীত। কিন্তু আপনি নিজেকে চিনতে পারলেন কি? আপনার তো উল্টোটা, গোটাটাই দেহতে। সত্যিই কি আপনি স্যাপিয়োসেক্সুয়াল? প্রেম মেধার সঙ্গে। যৌনতার সঙ্গে জড়িয়ে সৃষ্টি। হতেও পারে ! তবে, তাতেও সমস্যার শেষ না।


একদিন যার গান শুনে ভালবেসেছিলেন, তার গলা যদি কোনও কারণে নষ্ট হয়ে যায়? যার ছবি দেখে মুগ্ধতাই প্রেমের জন্ম দিয়ে ছিলো, মেট্রোর ভিড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যদি তার সামনের দুখানা দাঁত উপড়ে যায়। যে লোকটার অসীম জ্ঞানে তাকে বরণ করেছিলেন, সে যদি ধীরে ধীরে সব ভুলে যেতে থাকে। বিস্মৃতির গর্ভে চলে যায় তার সেই বিদ্যা। অ্যালজাইমার্স। তখন ভালোবাসা থাকবে তো? বড্ড জটিল এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া।


 আহারে বাহারে



তারচেয়ে অনেক সহজ সরল শরীরী প্রেমের দর্শন।

প্রেমবাজারের শেয়ার ওঠানামা করে শরীরের সঙ্গে। যোগা জিমের ছড়াছড়ির সঙ্গে ওই শেয়ার বাজারেরও সম্পর্ক আছে, মন্দজনে বলে। 'ত্বকের যত্ন নিন।' শরীর যেটুকু বেলেল্লাপনা করে বসেছে তা ঢাকতেই এত আয়োজন। রকমারি পোশাক আশাকের সম্ভার।


হালফ্যাশন। সাজগোজ মেয়েদের ব্যাপার ! সেই দর্শন আজ ইতিহাস। পুরুষরাও আজকাল দিব্য ফ্যাশন সচেতন। হাতের বুকের আসুরিক প্যাক দেখাতে আগেকার স্যানডো গেঞ্জি এখন নবরূপে। আগে তা থাকতো জামার তলায় লুকিয়ে। আজ জামা গেছে, স্যানডো আছে। আর আছে রোমশ বুকের উঁকিঝুঁকি। 

লোমভরা পা দেখানোও আজ ফ্যাশন। আগে ছিল হাফপ্যান্ট। মজদুর শ্রেণির জন্য। ঝুল বাড়িয়ে কমিয়ে আজ তা সার্বজনীন। ফ্যাশন ফানডা। থ্রি কোয়ার্টার, বারমুডা। আদিম পুরুষতন্ত্রের টেরা হোক বাঁকা হোক তবু সোনার আংটি, ওই কনসেপশন শেষ। 


তবে সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন এক জগাখিচুড়ি। লম্বা চুল, খোঁপা বাঁধা। আবার কানে রিং। বেশ একটা নারীসুলভ 'লুক'। আবার অন্যদিকে, সিক্স প্যাক এইট প্যাক শরীর। গাময় বাহারি উলকি। চুলের বাহার। সবমিলিয়ে এক বুনো 'হিম্যান' ব্যাপার। আবার পুরানের চলতা ফিরতা সংস্করণও বলা যেতে পারে। 


শরীরের খোলামেলা প্রদর্শনে নারীরাও। আগে কাঁধে বা পিঠের দিকে ব্রায়ের স্ট্র্যাপ উঁকি মেরে বসলেই হলো। লজ্জায় লাল। সখীর ফিসফিস- সামাল দেলো সই, পৈতে আউট। এখন ঘুরিয়ে ওটাই ফ্যাশন। লো কাট থেকে আরেকটু ডিপ কাট হোক। ক্লিভেজ শো অনেক হলো। আরেকটু সাহসী হও দেখি ম্যাডাম।

কিন্তু কেন এই খোলামেলা পোশাক? 


- 'এবার থেকে কি পুরুষদের জিজ্ঞাসা করে জামাকাপড় পড়তে হবে নাকি?' 

ক্লিশে হয়ে যাওয়া নারীবাদীদের এই উত্তর তো আছেই। 'বেশ করি। যা ভালো লাগে তাই পরি।' 

তাহলে পরের প্রশ্ন, ভালোটাই বা লাগে কেন?

"আত্মবিশ্বাসের অভাব মেয়েদের।" স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন কিংস্টন স্কুল অফ আর্টের, ডায়ভার্সিটির প্রফেসর ক্যারিন ফ্র্যাঙ্কলিন। "এই মেয়েরা নিজেরাই ভেবে বসে, তাদের যতটা ভালো হওয়ার কথা, তারা ঠিক ততটা ভালো নয়।" কি বলবো একে হীনমন্যতা? ক্যাথরিন বলেন, "এই মেয়েদের ভয়, তাঁরা ততটা ভালো না বলে, মনমতো বয়ফ্রেন্ড জুটবে না। তাই এরা আকর্ষণীয়, হট জামাকাপড় পরে 'ভালো না হওয়ার ঘাটতি' মেটাতে চায়। 


"ডেটিংয়ের সময় পুরুষ, নারী দুজনের ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়।" মত ইউনিভার্সিটি অফ নেব্রাস্কা'র যোসেফ বেঞ্জের সমীক্ষার। "পুরুষ নারী দুজনেই চায় দুজনার কাছে স্পেশাল হয়ে উঠতে। ডেটিংয়ে গেলে সঙ্গীকে আগলে রাখে পুরুষ। কোনভাবেই যাতে সে কোনও অসুবিধায় না পড়ে। সোজাকথায়, তখন বয়ফ্রেন্ডের ভূমিকা হয় পাহারাদার বা বডিগার্ডের। অন্যদিকে গার্লফ্রেন্ডের হাতিয়ার কোমল তুলতুলে দেহ। বডি ইমেজ। শরীর দিয়েই বাজিমাত। পোশাকের আড়ালেও নগ্নতা। শরীরের দুষ্টুমিষ্টি উঁকিঝুঁকি !


আপনার পোশাকই বলে দেয় আপনার পরিচয়। ফুটে ওঠে আপনার মানসিকতা। মত মনস্তত্ত্ববিদের। তবে যার পোশাক যতো মুখর, ততো ঢাকা পড়ে তার ব্যক্তিত্ব। এক জলজ্যান্ত মানুষ তখন 'সাবজেক্ট' না হয়ে 'অবজেক্ট'। পোশাক যে মানুষ সবসময় নিজের ইচ্ছেতেই পরে, এমনটাও নয়। অন্যের মন রাখতেও পোশাক পরতে হয়।

"লোগ মেক আপ করতে হ্যায় দিখানে কে লিয়ে। তুম ছুপানে কে লিয়ে করো।" 'জুলি' সিনেমার সেই ডায়লগ মর্মান্তিক বাস্তব।


 পাতি কেমিস্ট্রি





"মন নিয়ে কি মরবো নাকি শেষে?"

সত্যিই তো। শরীরের ভাষা বোঝাও সোজা, বোঝানোও সহজ। ঘোমটাকে 'দূর ছাই' করে আজ সব খোলামেলা। ইন্টুমিন্টু হলে দুজনেরই 'আঁখি হতে ঘুম কে নিল হরি?' হোয়াপে মেসেজ। "ভালো লাগছে না !" নিশুতি রাতের ফোনকল। বুক ধকধক। আরও কত কী যাচ্ছেতাই উপসর্গ। 


আরে মশাই গোটাটাই কেমিস্ট্রি। ওই 'অল্প অল্প ভাল লাগা থেকে', 'প্রেম একবার এসেছিল নীরবে', গোটাটাই রসায়নের খেলা। মগজের ষড়যন্ত্র। অক্সিটোসিন আর কর্টিসল ক্ষরণ। ব্যাস আপনি ঘায়েল। মন উড়ুউড়ু। প্রেম পায়। অক্সিটোসিন চাবুক কষায় প্রেমের ঘোড়া ছোটাতে। আর 'প্রেমেতে চাপ' বাড়ায় কর্টিসল। উদ্বেগ। প্রেমের ভ্রূণেই প্রোগ্রামিং করা উদ্বেগ। তাই প্রেম- উদ্বেগ জমে ক্ষীর। এবার আপনিই ঠিক করুন সেজেগুজে, গান গাইতে গাইতে, সেই ক্ষীরের স্বাদ চাখতে যাবেন কিনা?


ক্যানভাস কৃতজ্ঞতাঃ সংগৃহীত



মন্তব্যসমূহ