২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন কি মমতা বনাম শুভেন্দু হয়ে দাঁড়াল ?

 মমতার বাউন্সার ঠেকাতে ব্যাট হাতে নামবেনতো শুভেন্দু 



কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ১৯ জানুয়ারি 

এবার যদি বিজেপি নন্দীগ্রামের শীর্ষেন্দু, কৃষ্ণেন্দু বা অমলেন্দুকে প্রার্থী করে?
শুভেন্দু ভয় পেয়ে নন্দীগ্রাম থেকে সরে দাঁড়ালেন, একথা বলেই স্বস্তি পেতে চাইবে তৃণমূল। কিন্তু তার যুক্তি খাড়া করবে কীভাবে? 
শুভেন্দু অধিকারী কিন্তু একবারও বলেননি যে তিনিই নন্দীগ্রাম থেকে লড়াই চালাবেন। আবার শুভেন্দুর সেরকম ইচ্ছে থাকলেও, তাঁর নতুন শিবির বিজেপি তাতে সীলমোহর দেবে, তাও হলপ করে বলা যায় না। বরং এমনটাও হতে পারে, নন্দীগ্রামে শুভেন্দুকে দাঁড় করানোর ইচ্ছে হয়তো ছিলো। কিন্তু নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রার্থী হওয়ার ঘোষনার পর, আর সেই ঝুঁকির রাস্তায় হাঁটবে না পদ্ম শিবির। 

কেমন হতো আরও কিছুদিন যদি বিজেপিকে চাপে রাখা যেত?
প্রার্থী ঘোষনার একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওই চাপ জিইয়ে রাখা কিন্তু কোনও ব্যাপারই ছিলো না জোড়াফুল শিবিরের কাছে। 
বিজেপির বাংলার মুখ কে? নির্বাচনী প্রচারে নামার পর থেকে ওই একটাই প্রশ্ন অস্বস্তি বাড়িয়েছিল পদ্ম শিবিরের। ওই প্রশ্ন রক্তচাপ বাড়িয়েছিল দলের শীর্ষ কর্তাদেরও। 'বহিরাগত'- এর জিগির তুলে তৃণমূল কংগ্রেস এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যার পরিনতিতে, একসময় বাধ্য হয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছিলেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁকে বলতে শোনা গেছিল, বাংলার কোনও এক ভূমিপুত্রই বিজেপির মুখ হিসেবে সামনে আসবে। কিন্তু সেই মুখ কে? তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছিলোই। 

ঠিক এই পরিস্থিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষনায়, এক বাড়তি সুবিধা পেয়ে গেলো বিজেপি। সোমবার তেখালির জনসভায় একবারের জন্যও তিনি, অধিকারী পরিবারের কারুর নাম মুখে আনেননি। কিন্তু কাকে চ্যালেঞ্জ করে তৃণমূলনেত্রী আচমকাই নন্দীগ্রামে প্রার্থী হওয়ার ঘোষনা করলেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর ওই ঘোষনার পরেই বিজেপির 'পোস্টার বয়' হয়ে গেলেন শুভেন্দু অধিকারী। 

এর আগে শুভেন্দু অধিকারীকে সামনে রেখেই কাঁথি দক্ষিণ বিধানসভা, তমলুক লোকসভা দখল করেছিল তৃণমূল। তারপর মেয়াদ শেষের আগেই গত বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম বিধানসভা দখল করেন শুভেন্দু। এবার সেই অঙ্ক কষেই তৃণমূলনেত্রী সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন তাঁর দলছুট পুরনো সৈনিকের দিকে। ব্যাপারটা দাঁড়ালো, মারিতো গন্ডার লুটিতো ভান্ডারের মতোই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বেপরোয়া রাস্তায় হাঁটলেও, তাতে তাল ঠুকতে রাজি হননি শুভেন্দু অধিকারী। বরং এক বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের দক্ষতায় চ্যালেঞ্জ লুফে নেওয়ার আবেগ থেকে দূরেই থেকেছেন। সোমবার রাসবিহারীর মঞ্চ থেকে তিনি যে বার্তা দিলেন তাতেই তা স্পষ্ট। চ্যালেঞ্জের জবাবে শুভেন্দু বললেন, "হাফ লাখ ভোটে না হারাতে পারলে, রাজনীতি ছেড়ে দেবো।"
কাকে হারাতে চান শুভেন্দু তা তো বোঝা গেল। কিন্তু হাফ লাখ ভোটে জেতাবেন কাকে? তিনি কিন্তু সযত্নে নন্দীগ্রামে দাঁড়ানোর প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। বরং সেই দায় এড়াতে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, "মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাননীয়া কোম্পানির সিদ্ধান্ত ঘোষনা করে দিলেও, আমি তা পারি না। বিজেপিতে তা করা যায় না। কিন্তু দল আমাকে প্রার্থী করুক বা অন্য কাউকে, পদ্ম প্রতীক নিয়ে যেই লড়ুক, মাননীয়াকে হারাবোই হারাব।" 



এরপর আর কিছু বলার থাকে না। অ্যাডভান্টেজেই থেকে গেলেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু পিছনোর রাস্তা থাকলো না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কারণ তিনি সরাসরি মঞ্চ থেকে ঘোষনা করে বসেছেন, নন্দীগ্রাম থেকেই তিনি প্রার্থী হচ্ছেন। তবে তিনিও যে গোটাটাই আবেগে ভেসে করেছেন এমনটাও নয়। এক বিকল্প রাস্তাও খোলা রেখেছেন তিনি। নন্দীগ্রামের পাশাপাশি তাঁর খাসতালুক ভবানীপুরেও প্রার্থী হতে পারেন বলে জানিয়ে রেখেছেন তিনি।

কিন্তু সোমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তেখালির জনসভা আর শুভেন্দু অধিকারীর রাসবিহারীর জনসভা থেকে যেভাবে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়াছুঁড়ি হলো, তাতে মানুষ স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারলেন লড়াইটা কাদের মধ্যে। তৃণমূলের মুখ মমতা হলে বিজেপির মুখ শুভেন্দু। 
এখনও বঙ্গ রাজনীতির ভরকেন্দ্রে একটাই মুখ। আর সেই মুখের মালিক নিঃসন্দেহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নিজেও সেটা জানেন। আর সেজন্যই তাঁকে বলতে হয়, "বাংলার দুশো চুরানব্বই কেন্দ্রে প্রার্থী আমি।" এহেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য প্রতিপক্ষের যে মুখটি বেছে নিলেন, সেই মুখটি স্বাভাবিকভাবেই মর্যাদা পেয়ে যায় বাংলার বিকল্প মুখ হয়ে ওঠার।

একি শুধুই চমক? নাকি তৃণমূলনেত্রীর বোড়ের চাল। লম্ফঝম্প বন্ধ শুভেন্দুর। এবার তাঁর ব্যস্ত থাকতে হবে নন্দীগ্রাম সমেত মেদিনীপুরের খাসতালুক নিয়ে। ব্যস্ত থাকতে হবে কারণ নন্দীগ্রামে সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা গড় হিসেবে প্রতি একশোজনের মধ্যে কমবেশি তেইশজন। তৃণমূলনেতা শুভেন্দুর ওপর ভরসা রেখেছিলেন সংখ্যালঘু ভোটাররা। গত বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম প্রায় একাশি হাজার দুশো তিরিশ ভোটে এগিয়ে রেখেছিল শুভেন্দুকে। বিজেপির জার্সি গায়ে সেই লিড ধরে রাখতে পারবেনতো শুভেন্দু? 

দুই মেদিনীপুর সামাল দেওয়াও কিন্তু বাস্তবে মুখের কথা না। মোট পঁয়ত্রিশটি আসন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও সেকথা ভালোভাবেই জানেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে পূর্ব মেদিনীপুরের মোট ষোলটি আসনের মধ্যে তেরোটাই তুলে নিয়েছিল একা তৃণমূল। আর পশ্চিম মেদিনীপুরের উন্নিশ আসনের সতেরোটাই গেছিলো তৃণমূলের দখলে। এবারে তাঁর নতুন 'টিম বিজেপি'র হয়ে হুঙ্কার ছেড়েছেন শুভেন্দু- পঁয়ত্রিশের পঁয়ত্রিশটাই চাই। ঘটনায় পরিষ্কার, এবারেও মেদিনীপুর জিততে ব্যাট বল হাতে নামবে জোড়াফুল আর পদ্ম শিবিরই। 


শুভেন্দুর সেই লড়াইকে কঠিন করে তুলতে তৃণমূল সুপ্রিমো এগিয়ে এনেছেন রামনগর বিধায়ক অখিল গিরি, পিংলার বিধায়ক সৌমেন মহাপাত্রর মতো দলের অনুগতদের। দলে এঁদের পূর্ব পরিচয় ছিলো অধিকারী পরিবারের বিরোধী হিসেবেই। তার ওপর এবার নন্দীগ্রামে হাজির খোদ তৃণমূলনেত্রী। 

সব মিলিয়ে এক দারুণ ফিল্ডিং সাজিয়ে শুভেন্দুর আপনগড় মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম ময়দানে বোলিং করতে নামবেন দলনেত্রী। ব্যাট হাতে বিজেপি শেষ পর্যন্ত কাকে নামায় সেটাই দেখার। কারণ 'টিম বঙ্গ বিজেপি'র বর্তমান ব্যাটিং লাইনের চেহারাটা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে পেছনে চলে গিয়েছে বিজেপির পুরনো মুখগুলো। তার জায়গায় একেবারে সামনে চলে এসছেন তৃণমূল দলছুট নব্য বিজেপিরাই। 

তবু সোমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে চমকটা দিলেন, তা একেবারে শেষ মুহূর্তের জন্য তোলা থাকলে খেলাটা আরও জমে যেত। মমতার বাউন্সারের মুখোমুখী হতে নন্দীগ্রামের পিচে কাকে নামাবে, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তার সুযোগ কমে যেত পদ্ম শিবিরের। এখন দেখার বিজেপির সাজঘর থেকে ব্যাট হাতে কে ময়দানে নামেন। সেখানেও কোনও চমক অপেক্ষা করছে কিনা কে জানে?

মন্তব্যসমূহ