রবিবাসরীয় বিশেষ - কাজল ভট্টাচার্যের অনুভুতিতে

 আজ প্রিয়জনকে খুজে নেবার আকুল আকুতির দিন 


 । হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা ।




- কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ফেব্রুয়ারি ১৪


(দুনিয়ায় কতোই না মানুষ হারিয়ে যায়। সবাই কি স্বেচ্ছাতেই হারায়, নাকি অনিচ্ছাতেও? সব হারানোর পেছনেই কি কারণ থাকতে হয়? আবার সবার মধ্যে থেকেও হারিয়ে যায় অনেকে। হারিয়ে যাওয়া মানুষের, দু- একজন আবার ফিরেও আসে।)


স্টেশনের রংচটা দেওয়ালে ঝোলে এমন কতোই না মুখ।

তারা সবাই হারিয়ে গেছে। এমনও হতে পারে, এক লড়াই চলছিল নিজের একঘর যন্ত্রণার সঙ্গে মানুষের। সেই অদৃশ্য লড়াইয়ে জিতে গেছিল যন্ত্রণা। তাই ঘরের বেদখল হয়েছিল মানুষ। আবার লড়াইটা হতে পারে নিজের সঙ্গে নিজের। পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল মানুষটা নিজের গণ্ডী ছেড়ে। তাহলে কি, সব হারিয়ে যাওয়ার পেছনেই এক সূক্ষ্ম কারণ লুকিয়ে থাকে?

আমরা দেখতে পাই শুধু হারিয়ে যাওয়া, পলাতক সেই মানুষটাকে। রণেভঙ্গ দেওয়া সৈনিককে কেই বা কবে সম্মানের চোখে দেখেছে? সস্তার নিউজপ্রিন্টে ছাপা হ্যান্ডবিল। নামধাম পদবী বয়স ফর্সা কালো রোগা পাতলা লম্বা বেঁটে বয়স ঠিকানার বারমাস্যা। তবে ছবির যা হাল, তা দেখে মানুষ চেনার উপায় থাকে না। ফ্যাকাশে এক মুখের ছবি। অবশ্য এদের মধ্যেও দু- চারজন ভাগ্যবান থাকেন বৈকি। তাঁদের ছবি ছাপানো হয় খরচপাতি করে। কোনও ছবির নীচে লেখা- 'বাপী ফিরে আয়।'

গন্তব্যের জন্য ট্রেনের টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে চোখ পড়ে দেওয়ালের হ্যান্ডবিলে। সন্দেহ হয় এই লাইনেও এমন কেউ কি দাঁড়িয়ে আছে, যে সেই দিকশূন্যপুরের টিকিট কাটবে? নাকি বিনা টিকিটেই অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমায় সেই ঘরছাড়ারা?

তবে বেশিভাগ মানুষই দেওয়ালে ঝোলা মুখগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না। কোনও 'ফেস ভ্যালু' নেই ওদের। নেই বলেই অমন অবহেলায় দেওয়ালে ঝোলে। নইলে পাশে কোনও সুন্দরীকে নিয়ে, নিদেনপক্ষে তেল বা সাবানের বিজ্ঞাপন হয়ে ফ্লেক্সে ঝুলতো।

আপন পর কারুর কাছেই ফেস ভ্যালু ছিলো না মানুষগুলোর। তাই কি মানুষগুলো হারিয়ে গেলো? এক দুরন্ত অভিমান ঘরছাড়া করলো তাদের? নাকি কোনও সুদূরের টানে পা বাড়ালো তারা? আবার অনেকেই ঘরছাড়া হয় নিজেদের স্বপ্নসন্ধানে। ঘর ছেড়েছিলেন নিমাই। কিন্তু যাওয়ার আগে বেশ বলে কয়ে গেছিলেন। অনুমতি নিয়েছিলেন মা শচীদেবী, স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর যাত্রাও তো সেরকম হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। যাওয়ার সময় কোনও পিছুটান রেখে যেতে চায়নি তারা। কপিলাবস্তুর রাজকুমার সিদ্ধার্থর মতো। আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাত। গভীর রাতে চুপিসারে স্ত্রী, সন্তানের মুখচুম্বন করে পৌঁছলেন অনোমা নদীতীরে। ত্যাগ করলেন রাজপ্রাসাদের বিলাসব্যাসন। মনের লাগাম শক্ত হাতে ধরে পা বাড়ালেন অনন্তের পথে। অজানা সন্ধানে।



কোনও এক অজানা প্রান্তরে কখনও কি দুজন এমন মানুষের দেখা হয়, যারা দুজনেই হারিয়ে গেছে? নাকি তারা মহাকাশ থেকে খসে পড়া উল্কার মতো? কোনও গন্তব্য নেই। আবার থাকলেও সেখানে পৌঁছনোর আগেই পুড়ে খাক হয়ে যায়।

যারা হারিয়ে যায় তারা সবাই কি একইরকম? নাকি যারা একরকম তারাই হারিয়ে যায়? কে জানে। এতো কোনও ছেলেধরার হাতসাফাই না। সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। তারমানে এরা কেউ হারিয়ে যায় না। বাড়ি ঘরদোর আপনজনদের ছেড়ে চলে যায়। হারিয়ে যায় স্বেচ্ছায়। কেউ এদের টেনে রাখতে পারে না। পিছুটান কেটে যায় বলেই স্বেচ্ছা নির্বাসন।

ঠিক যেমন পৃথিবীর টান না থাকলে আপেলটা মাটিতে আছড়ে পরতো না। আমরাও হয়তো সম্পৃক্ত হয়ে থাকতাম না পৃথিবীর বুকে। উধাও হয়ে যেতাম অনন্তে। কিছুই থাকতো না জীবন মৃত্যু বলে। শূন্য পৃথিবীর বুক। হুলুস্থুলু হয়ে যেতো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা সবাই সবাইকে ধরে রাখে। ওই টানে কম পড়লেই অবধারিত বিপর্যয় সৌরমণ্ডলেও।

সংসারের টান ছিটকে একজন মানুষ বেরিয়ে গেলে জগতের কিছু আসে যায় না। সংসার তোলপাড় হয় একশো কুড়ি ঘণ্টা। তারপরেই থিতিয়ে আসে আবেগ। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটার বিছানা দখল করে পরিবারের আরেকজন। পাবদল হয় ঘরে পরার স্লিপারটারও। একে একে সব চিহ্নগুলি মুছে যেতে থাকে হারিয়ে যাওয়া মানুষটার। তারপর আর তার ঘর বলে কিছু থাকে না। জায়গা হয় ঘরের দেওয়ালে।

একটা আস্ত মানুষ। সে তার শরীর মন দুটো নিয়েই হারিয়ে যায়। নাকি মনটা পড়ে থাকে সেই বিছানায়? যে চাদরটায় মাখামাখি তার গায়ের গন্ধ। বালিশে তখনও জড়িয়ে ছেড়ে যাওয়া মানুষটার মাথার কয়েকগাছা চুল। বড্ড চুল ঝরতো তার। তারপর একদিন গোটা মানুষটাই ঝরে গেলো।

অ্যাসট্রেতে তখনও তার খাওয়া পোড়া সিগারেটের ফিল্টার টিপসগুলো। প্যাকেটে রাখা আরও তিনটে। দেশলাইর গায়ে আর আগুন নেই। খালি।

একি হঠাত উবে যাওয়া? নাকি প্রস্তুতি চলছিল অনেকদিন ধরেই। নিজের ঘরে থেকেই সম্পূর্ণ এক আলাদা মানুষ সে। সবাই সবার মতো থাকে, সে থাকতো এক দ্বীপে। জনমানবহীন স্বরচিত সেই নির্জন দ্বীপ। দিনেরাতে শুধুই ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। পারে মাথাকূটে মরা। তবু সমুদ্রের টানে ঢেউয়ের বারেবারে ফিরে যাওয়া সমুদ্রেরই বুকে। সেই একঘেয়ে কোলাহলেও এক তীব্র নৈশব্দের ভাষা। আর সেই দুনিয়ায় বেঁচে থাকা আরও কষ্টসাধ্য এক ব্যাপার।



মানুষটা সবার মধ্যে থেকেও, কারুর মধ্যে নেই। তার শরীরটাকে অনায়াসে ছোঁয়া যায়, চাইলে ধরাও যায়। কিন্তু মনের হদিশ পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে শরীরের ওপর চেপে বসতে থাকে মন। তারপর একদিন সেই অমোঘ ক্ষণ। মনের ডাকে সাড়া দিয়ে হারিয়ে যায় শরীরটাও।

আবার দু- একজন থাকে, যারা কোথাও না গিয়েই হারিয়ে যায়?

সিগারেটের দোকানে তার সঙ্গে আগেকার মতোই এখনও অনেকদিন দেখা হয়ে যায়। চোখে চোখ পড়লে এখন আর কথা বলে না সে। মাথা নেড়ে, একটু হেসেই তড়িঘড়ি চলে যায়। মাস্টারদায় মেট্রোর ভিড় এড়িয়ে মাথা নীচু করে এগিয়ে যায়। আগের মতো রোজ না হলেও, আজও অনেকদিন সেই চা দোকান থেকেই চা খায়। তবে রেলিংয়ে ভর দিয়ে চা খাওয়ার সময় সঙ্গে আর কেউ থাকে না। মানুষটা সবার মাঝে থেকেও কারুর মাঝে নেই। এভাবেই হারিয়ে যায় এই শহরের কোনও এক নাগরিক। তার মুখের ছবি দিয়ে কোনও স্টেশনের দেওয়ালে হ্যান্ডবিল সাঁটানো হয় না। পুলিসের খাতাতেও তার নাম ওঠে না।

আর যাদের মুখের ছবি দিয়ে হ্যান্ডবিল ঝোলে, থানায় ডায়রি হয়, পুলিস তাদের খোঁজ চালায়।

সবাই যখন সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটার কথা ভুলতে বসেছে, ঠিক তখনই মাঝরাতে কোনদিন একটা কল আসে - 'হ্যালো থানা থেকে বলছি। একবার আসতে হবে।'

হারিয়ে যাওয়া মানুষের কোনও একজন ফিরে আসে নিজের ঠিকানায়, তবে লাশ হয়ে।

মন্তব্যসমূহ