বেহালার দিন প্রতিদিন দুর্গাপূজা বিশেষ সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের কলমে - " অব তেরা কেয়া হোগা বাসন্তী "

 দুর্গাপূজা বিশেষ 

অব তেরা কেয়া হোগা বাসন্তী 




- কাজল ভট্টাচার্য 

শারদ রিয়ালিটি শো। দেবীগিরি।
সে এক হইচই ব্যাপার। শো চলছে তো চলছেই। হেব্বি হেব্বি তারকাদের নিয়ে দু- চারবছর শো চালাবার পরে, চ্যানেল কর্তারা ভাবতে বসেন। টিআরপি'র হিসেবনিকেশ কষে তবেই শোয়ের আয়ুবৃদ্ধি। কিন্তু শারদ শো নিয়ে ওসবের বালাই নেই। বাঙালির পাতে ফেললেই হলো! জবরদস্ত হিট। গুনে গুনে লাগাতার দুই পক্ষ। তাই সাজসাজ রব মর্তের এক চিলতে ভূখণ্ড পশ্চিমবঙ্গে।

'দেবীগিরি!'
মর্তের এমন হিট শো বলে কথা। কৈলাসে তার আঁচ না লেগে পারে? মহেশ্বরের অবশ্য একটুও ইচ্ছে না যে দুর্গা মর্তের বিচারকদের সামনে পরীক্ষায় বসুক। কিন্তু গিন্নির বাপেরবাড়ির অনুষ্ঠান বলে কথা। মুখ খুললে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই ফিবছর পিতৃপক্ষের শুরু থেকেই কৈলাসে ধুন্ধুমার কাণ্ড। 
এখন আবার আগের মতো ষষ্ঠীর দিনের জন্য অপেক্ষা নেই। দেবীপক্ষের শুরুতেই মর্তে আগমন দেবীর। তাও আবার সপরিবার। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের বাক্সপ্যাটরা গোছানোর কাজ। সেই সঙ্গে চলছে পরীক্ষার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। সুযোগ পেয়ে গেছে সরো। মাকে জ্ঞান দেওয়ার মওকা হাতছাড়া করতে চায় কোন মেয়ে? 

জেনারেল নলেজটা তাগড়া চাই। নিরাপত্তা, পরিবেশ, শব্দবিধির আইনকানুন নিয়ে মাকে আপ-টু-ডেট করে তুলতে দারুণ ব্যস্ত সরো। সরোর ওপর ভর করেই লক্ষ্মীলাভ। নগদে মেডেলে পুরস্কার। তাহলে গুরুত্বটা কার বেশি?

- 'হুঁ হুঁ বাবা, আমাকে ছাড়া উপায় নেই।' লক্ষ্মী দিদির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে বোন সরস্বতী।
এমনিতে চঞ্চলা হলে হবে কী, বোনের কথায় সর্বদাই কানখাড়া দিদি লক্ষ্মীর।
এখানেই বিবাদ দুই বোনের সরো আর লক্ষ্মীর। কোনটা বেশি জরুরি? আগে বিদ্যা পরে সম্পদ নাকি উল্টোটা। নাক কুঁচকে লক্ষ্মী বলে- 'গিয়ে দেখ না একটা ঝাঁ চকচকে স্কুলে। ভর্তি হতে কত টাকা লাগে।'
- 'লাগে টাকা দেবে কুরের।' মুচকি হেসে বলে সরস্বতী। বোনের কথা শুনে ফোঁস করে ওঠে লক্ষ্মী। দিদিকে একটুও পাত্তা না দিয়ে সরস্বতী ফের মুখ খোলে- 'জ্ঞানের আকাল পাবলিকের। তাই তোমার কাছে 'টাকা টাকা' করে হেঁদিয়ে মরলো। জানলোই না, লক্ষ্মীর দপ্তর জনগণের জীবনের লক্ষ্য স্থির করা ছাড়া আর কোনও কাজে আসে না।'
কথাটা মোটেই ভুল বলেননি সরস্বতী। জীবনের 'শ্রী' ফেরায় বলেই লক্ষ্মীর আরেক নাম 'শ্রী'। ধন সম্পদ দপ্তরের মন্ত্রী দেব কুবের। 
- 'আমিও কিন্তু তোমার দপ্তরের 'হাফপ্যান্ট' মন্ত্রী,' আগুনে ঘি ঢালার মতো ফের দিদিকে বিঁধলো সরস্বতী। 
- 'হাতে যবের শিষ ধরিয়ে লক্ষ্মীত্ত্বের ভাগিদার করা হয়েছে আমাকেও। তাই আমার পুজোর তিথি পঞ্চমীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে শ্রী- শ্রীপঞ্চমী।'
ব্যাস আর যায় কোথায়! শুরু হয়ে গেলো দুই সতীনের ঝগড়া। সতীনই বটে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে, লক্ষ্মী সরস্বতী দুই বোনের গলাতেই মালা দিয়েছিলেন বিষ্ণু।


সরস্বতীর সবকথা মনোযোগ দিয়ে শুনে রাখলেন মা দুর্গা। কে জানে, ফাঁদে ফেলতে বিচারকরা কখন কী প্রশ্ন ছুঁড়ে মারেন। মনে মনে মেয়েটার তারিফও করলেন মা- সত্যিই, কত্ত জানে ওই পুচকি মেয়েটা! 
আজকাল আর সবকথা মনে রাখতে পারেন না দেবী। মেঘে মেঘে বয়স তো নেহাত কম হলো না। শুধু দেবাদিদেবের আদর যত্ন, স্নেহে আজও শরীর মনের সেই তেজটা ধরে রাখা গিয়েছে। এই যা!
দেবীর সেই গনগনে আগুনের মতো রূপেরই বিচার করবে মনুর সন্তানরা। বিচারকের ছদ্মবেশে আসবে শারদ রিয়ালিটি শোতে। খোদ সরস্বতীর সামনেই মায়ের রূপ ঠিক কতটা সূক্ষ্ম শিল্পসম্মত তার চুলচেরা বিচার করবে সরস্বতীর বরপুত্ররা। এসব বিচার বিশ্লেষণে পাশ করলেই হলো না, তারপর থাকছে নিরাপত্তা, পরিবেশ সচেতনতার মতো হাজারগণ্ডা ফ্যাকরা। খোদার ওপর খোদকারির সেরা নিদর্শন।

গলায় কার্ডফার্ড ঝুলিয়ে অভিযানে নেমে পড়তে তৈরি হচ্ছে বিশেষজ্ঞের দল। প্যান্ডেলে পা পড়লেই তাদের হাবভাব নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মতো। সঙ্গে লোকলস্কর পাইক বরকন্দাজ। তাঁদের ঘিরে পুজো আয়োজন কর্তারা। রসভর্তি গামলা থেকে চিমটেতে তোলা রসগোল্লার মতো টুপটাপ করে বিনয় ঝরে পড়ে সর্বাঙ্গ থেকে। আর এঁদের সবাইকে ঘিরে লাইট ক্যামেরা মিডিয়ার নজরদারি। সবমিলিয়ে সেও এক রাজসূয় যজ্ঞ। 
প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে একদল বিশেষজ্ঞ হানা দেন। তাঁরা বিদায় নিতেই আরেকদল আসেন। ষষ্ঠীপুজোর আগেই ঠাকুরের বিচার সেরে ফেলেন মনুর সন্তানরা। টানটান উত্তেজনা মণ্ডপে মণ্ডপে। তটস্থ ঠাকুর দেবতারা। এখন আর অসুরে দুগ্গাতেই মহারণ না। ঘোর যুদ্ধ দুগ্গা দুগ্গায়। গিরীশ পার্কের দুগ্গার সঙ্গে বেহালার দুগ্গার। ফুলবাগানের সঙ্গে গড়িয়ার। শুধুমাত্র কলকাতাতেই সেরার লড়াইয়ে নামবেন সরকারি নথিভুক্ত কমবেশি হাজার আড়াই দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। আর জেলাগুলোতে থাকছেন হাজার পঁচিশ দুর্গা। শহর ছাড়িয়ে যুদ্ধ ছড়িয়েছে বাংলার জেলায় জেলায়। 


বাঙালির মনের রং ঠিকঠাক ধরে ফেলেছিল এশিয়ান পেন্টস। পেন্টস কর্তাদের হাত ধরেই সূচনা 'শারদ সম্মান'- এর। সালটা ছিলো ১৯৮৫। কলকাতার সব দুগ্গাদের হারিয়ে, সেবছর সেরার মুকুট পরেছিলো আদি বালিগঞ্জ, যোধপুর পার্ক আর ম্যাডক্স স্কোয়ারের দুগ্গারা। তারপর দেড়, দু'দশক কাটতে না কাটতেই, সেই 'শারদ সম্মান'ই রূপ নিলো রিয়ালিটি শোয়ের। উৎসব আর নিছক উৎসব থাকলো না। হয়ে দাঁড়ালো প্রতিযোগিতা। আর সেই প্রতিযোগিতা সুপার ডুপার হিট হতেই নড়েচড়ে বসলেন কর্পোরেট, সংবাদমাধ্যমের চ্যানেলকর্তারা। 
বাজারচলতি অন্যান্য রিয়ালিটি শোয়ের মতো 'দেবীগিরি' কোনও নির্দিষ্ট এন্টারটেনমেন্ট চ্যানেলেই না, হরেক নিউজ চ্যানেলও হয়ে বসলো এই শোয়ের অর্গানাইজার। আবার প্রতিবছরই অর্গানাইজারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
আর বাড়বে নাই বা কেন? শোয়ের কন্টেসটেন্ট কে, সেটা দেখতে হবে তো! দেবাদিদেব মহেশ্বরের ঘরণী। কেবিসি'র কেতায় ব্যবস্থা আছে লাইফ লাইনের। হট চেয়ারে দুগ্গাঠাকুর বসলে তাঁর লাইফ লাইন হয়ে হাজির লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ। আবার আড়ালে থাকেন খোদ মহেশ্বরও।
'পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে 
স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে 
ড্রয়িংরুমে রাখা বোকাবাক্সতে বন্দি..'
মহিনের সেই ঘোড়া দৌড়তে দৌড়তে আজ পৌঁছে গিয়েছে স্বর্গে। আর তাই বোকাবাক্সের দৌলতে স্বর্গমর্ত সব মিলেমিশে একাকার। 

বছরের পর বছর বাজিমাত করে চলেছেন একা দুর্গাই। দেবীর জৌলুসে যেন এতটুকুও ঘাটতি না থাকে, তাই আর্থিক অনুদান নিয়ে হাজির খোদ সরকার বাহাদুরও। প্রতিযোগী যখন এমন ভিভিআইপি, তখন শোয়ের নিয়মে হেরফের তো থাকবেই। বিচারকের বেঞ্চ নিজেই ছুটবে প্রতিযোগীর কাছে। সেখানেই চলবে প্রতিযোগীর গুণাগুণের লিটমাস টেস্ট।
'ও দয়াল বিচার করো!' সাউন্ড সিস্টেমে বেজে চলেছে। গানের সঙ্গে পা ঠুকে তাল মিলিয়ে চলছে কার্তিকের তাল দেওয়া। ওদিকে সিদ্ধিদাতা ভাবেন, মামাবাড়ির দয়ালটা কে? কারণ বিচারের দায়িত্ব তো নিয়ে বসেছেন মনুর সন্তানরাই।
মনুসন্তানদের আদালতে জিতে যান বাগবাজারের দুগ্গা, হেরে যান গড়িয়ার দুগ্গা। উৎসবেও হারজিত। অঙ্ক কষা সেরা অসেরার। সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট। বোকাবাক্সে সেরা ঠাকুর সেরা পুজোর খবর শুনে বেরিয়ে পড়েন উৎসাহীরা। সেরা না হতে পারা দুর্গারা মনখারাপ করে বসে থাকেন। বাপেরবাড়ির এহেন কীর্তিতে, ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে লজ্জায় রাঙা হন দেবী দুর্গা।



গত পাঁচ সাত বছরের রেকর্ড ঘেটে চলেছে কাত্তিক। ঠিক কী ধরনের প্রশ্ন করেন রিয়ালিটি শোয়ের দিগগজরা। সরস্বতী সেসব প্রশ্ন দেখে নোট তৈরি করে চলেছেন। সব দেখেশুনে গম্ভীর গণেশ। একটাও কথা নেই মুখে। সব বিচারকদের বিচারে তিনি আদৌ খুশি হতে পারেননি। বিচারবুদ্ধিতে ঠিক কজনের সিদ্ধিলাভ হয়েছিল, ভাবছেন তা নিয়েই।

আগে বিভেদ ছিলো মানুষে মানুষে। সেই বিভেদ এখন চিন্ময়ী দেবীরূপেও। আগে ডাকের সাজে, একচালার দেবীমূর্তিতেই বেশ ছিলাম! মরতে মানবীরূপ নিলাম। আক্ষেপ দুগ্গার। দেবীমূর্তিকে মানবীরূপ দিয়ে, রূপবদলের ইতিহাস তৈরি করে বিখ্যাত হয়ে গেলেন শিল্পী। আর এখন ঠেলা সামলানোর দায় দুগ্গার। 
যুগের পর যুগ ধরে দেবীকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে মহিষাসুর। মনুর সন্তানদের কেরামতিতে এতদিনে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেখে খুশিতে ডগমগ মহিষাসুর। কপালে ভাঁজ দেবী দুর্গার। দেবীকে বিপাকে পড়তে দেখে হেসেই অস্থির মহিষাসুর।
- অব তেরা কেয়া হোগা বাসন্তী ?
ছবিঃ সংগৃহীত 

মন্তব্যসমূহ