ভবানীপুরে জয়ের পর মমতার লক্ষ্য দিল্লী

 
ভবানীপুরের 'মিনি ইন্ডিয়া' দখলের পর জোড়াফুলের নিশানায় দিল্লি


- কাজল ভট্টাচার্য 
মেঘেরাও যেন অপেক্ষা করছিলো কলকাতার আকাশে। ভবানীপুর উপনির্বাচনের ফল ঘোষণা হতেই আকাশভেঙে বৃষ্টি। নির্বাচনী জয়মাল্য গলায় উঠলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
কে বললো বিজয় উৎসব করা চলবে না? কমিশনের ফতোয়া উড়িয়ে আকাশবাজির প্রচন্ড গর্জনে কেঁপে উঠলো শহর। ঝোড়ো হাওয়ায় বৃষ্টির জল কুয়াশার মতো উড়লো দিগ্বিদিক জুড়ে। অকাল নির্বাচনের মতোই অকালবৃষ্টি। অকাল নির্বাচন কারণ মাত্র পাঁচমাস আগেই নির্বাচনের আসর বসেছিল বাংলা জুড়ে। ভবানীপুর আসন দখল করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ইস্তফা দেওয়াতেই এই উপনির্বাচন।

ভবানীপুর আসন যে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দখলে যাবে তা শুধু প্রত্যাশিতই না, ছিলো ভীষণরকম নিশ্চিত। তবে চ্যালেঞ্জ ছিলো একটাই। ঠিক কত ভোটের ফারাকে জিতবেন মমতা? কারণ ওই ফারাকের অঙ্কই হিসেব কষে একটুও ভুল না করে জানিয়ে দেবে, তৃণমূল সুপ্রিমোর ক্যারিশমা আজ ঠিক কোন পর্যায়ে।

কয়েকমাস আগে এপ্রিলের নির্বাচনে ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি'র রুদ্রনীল ঘোষকে ২৮ হাজার ৭১৯ ভোটে হারিয়েছিলেন জোড়াফুল শিবিরের শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। উপনির্বাচনে ওই কেন্দ্রের প্রার্থী যখন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন ভোটের মার্জিন ঠিক কতটা বাড়ে সেদিকেই নজর ছিলো গোটা বাংলার। দুপুর আড়াইটা নাগাদ সেই প্রশ্নের উত্তর মিললো। বিজেপি'র প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়ালকে ৫৮ হাজার ৮৩৫ ভোটে পেছনে ফেলে ভবানীপুর বিধানসভার দখল নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে প্রমাণ হলো ক্যারিশমার প্রশ্নে জোড়াফুল শিবিরের বর্ষীয়ান নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি এগিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেইসঙ্গে অতীতের সব রেকর্ডকেও এবার ভেঙে দিলেন তৃণমূলনেত্রী। ভবানীপুরবাসী শিবির বদল না করায় বিধায়কের মুখ বদলালো ঠিকই, বদলালো না জোড়াফুল ছাপ। 

একেই বোধহয় বলে ললাট লিখন। পরপর দুবার আটান্ন হাজারের ফাঁসে আটকে গেলেন প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। কয়েকমাস আগের নির্বাচনে এন্টালি বিধানসভায় তৃণমূলপ্রার্থী স্বর্ণকমল সাহার কাছেও ৫৮ হাজার ২৫৭ ভোটে হেরে যান পদ্মশিবিরের টিবরেওয়াল। আর এবার ভবানীপুর উপনির্বাচনেও ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটে হারলেন তিনি। কিন্তু কেন এই বিশাল ফারাকে হার? সংগঠনের দুর্বলতা, সাফকথায় জানিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। তারসঙ্গে তিনি জুড়ে দিয়েছেন ছাপ্পা ভোটের অভিযোগও। 
#
ভবানীপুর উপনির্বাচন নিয়ে যে জোড়াফুল শিবিরে বিন্দুমাত্রও উদ্বেগ ছিলো না, এমনটা বললে বাড়াবাড়ি হবে। আর তাই শিবিরের সব হেভিওয়েটরাই নেমে পড়েছিলেন ভবানীপুরের নির্বাচনী কুরুক্ষেত্রে। আসলে শুধু ভোটযুদ্ধে জেতাই না, ভোটের ফারাক বাড়ানোটাই ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবে ভবানীপুর উপনির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো এক চ্যালেঞ্জ- তৃণমূলনেত্রীর মর্যাদা রক্ষার লড়াই। সেই চ্যালেঞ্জের যোগ্য জবাব দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তবে এরপরেও আরেকটি চ্যালেঞ্জ পড়ে রইলো। আর এই চ্যালেঞ্জ কোনও রাজনৈতিক শিবিরের ছুঁড়ে দেওয়া নয়। চ্যালেঞ্জ ভবানীপুরবাসীর। একটি ভোটও যাতে নষ্ট না হয়। মাত্র এই একটি ইস্যুতেই যাবতীয় রেষারেষি শিকেয় তুলে, সহমত হতে পেরেছিল প্রতিদ্বন্দ্বী সবকটি রাজনৈতিক শিবির। কিন্তু তার ফল কী দাঁড়ালো?
মাত্র কয়েকমাস আগে মার্চ- এপ্রিলে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন। সেসময় ভবানীপুর বিধানসভায় ভোট পড়েছিল ৬১.৭২ শতাংশ। আর এবার সেপ্টম্বরের উপনির্বাচনে তা ঠেকলো ৫৭.৯ শতাংশে। 
ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক দেখাতে ইতিমধ্যেই নানারকম পরিসংখ্যান পেশ করা হয়েছে। তাতে স্পষ্ট, অতীতেও মতদানের ব্যাপারে চরম অনীহা দেখিয়েছে ভবানীপুর। কিন্তু কেন এই অনীহা?

ভোটে জেতাহারা নিয়ে নিয়ম করে বোকাবাক্সের বিতর্কে সব শিবিরের প্রতিনিধিরাই সহস্র যুক্তি পেশ করেন। সবার দাবি মানুষ তাদের পক্ষে। কিন্তু ভবানীপুরের প্রতি একশোজন মতদাতার মধ্যে যে বিয়াল্লিশজনেরও বেশি কোনও পক্ষকেই সমর্থন করতে অপারগ, তাঁদের নিয়ে সবার মুখে কুলুপ আঁটা কেন? 
হয় আমাদের নাহয় ওদের। এরকম এক ধারনায় ভোগেন বঙ্গের রাজনীতিবিদরা। ভোটের লাইনে দাঁড়াতে অনিচ্ছুক ভবানীপুরের বাসিন্দাদের নিয়ে কী বলবেন রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা? ভোটে উৎসাহ হারাচ্ছেন এমন মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম না। তাঁরা কি কোনও দলের ওপরেই ভরসা রাখতে পারছেন না? নাকি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই? 
এই প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হবে প্রতিটা দলকেই। এমনকি এর দায় এড়াতে পারে না খোদ নির্বাচন কমিশনও। ভবানীপুর উপনির্বাচনে এই ঘটনার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিলো একহাজার চারশো তেপ্পান্নটি নোটা ভোট। কোনও দলই ভোট দেওয়ার উপযুক্ত নয়। দ্বিধাহীন ভাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছেন মানুষ।

'আমরা মানুষের সঙ্গে আছি।' সিপিএমের এই কথায় ভরসা রাখতে পারলো না ভবানীপুর। তার সরাসরি প্রতিফলন ইভিএমেও। মাত্র পঁচাশি ভোট নিয়ে চলা শুরু করেছিলেন বামফ্রন্টের সিপিএম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাস। পথের শেষে শ্রীহীন হয়ে পড়লেন শ্রীজীব। তাঁর যাত্রা শেষ হলো মাত্র চারহাজার দু'শো ছাব্বিশ ভোটে।
শুধু ভবানীপুরেই না, সমশেরগঞ্জ, জঙ্গিপুরেও জামানত বাজেয়াপ্ত হলো বামেদের।
অন্যদিকে ভবানীপুরে জোড়াফুলের শিবিরে জমা পড়লো ৮৫ হাজার ২৬৩ ভোট। পদ্ম শিবিরকে সন্তুষ্ট থাকতে হলো ২৬ হাজার ৪২৮ ভোটে।
 



পশ্চিমবঙ্গে যে নয়া রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়েছে তার স্পষ্ট ছবি ধরা পড়েছিল মাস পাঁচেক আগের বিধানসভা নির্বাচনেই। অঙ্কের হিসেবে স্পষ্ট হয়েছিল যে বাংলার রাজনীতির মেরুকরণ সম্পূর্ণ। সেই নয়া সমীকরণে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে তৃণমূল। আর বিরোধীদল হিসেবে উঠে এসছে একমাত্র বিজেপি। ধুয়েমুছে সাফ কংগ্রেস বামফ্রন্ট। 

এবার ভবানীপুর উপনির্বাচনেও ফিরে এলো সেই একই ছবি। রবিবার সকাল আটটায় ভোটগণনা শুরু পোস্টাল ব্যালট দিয়ে। জয়ের শুভ সূচনা হলো তৃণমূলনেত্রীর। এরপরেই চললো একুশ রাউন্ডের ভোটগণনা। প্রথম রাউন্ডেই তিন হাজার ছশো আশি ভোট পেয়ে এক নাম্বারে থাকলেন ভবানীপুর প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওদিকে আটশো একাশি ভোট পেয়ে দু'নাম্বারে উঠে এলেন বিজেপির প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। ভোটের ফারাক দু'হাজার সাতশো নিরানব্বই। 
দ্বিতীয় রাউন্ডে ভোটের ফারাক খানিকটা কমলেও এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শুধুই লাগাতার এগিয়ে যাওয়া।

ভবানীপুরের 'মিনি ইন্ডিয়া' জেতার পর এবার দিল্লি দখলের স্বপ্ন দেখছে জোড়াফুল শিবির। কারণ মিশ্র ভাষাভাষীর এই বিধানসভা কেন্দ্রের মোট আটটি ওয়ার্ডের সবকটিতেই এগিয়ে ছিলো তৃণমূল কংগ্রেস। একদিকে অতীতের সব নজির ভেঙে এবার রেকর্ড ভোটের ফারাক, অন্যদিকে ভবানীপুরের অবাঙালি ভোটব্যাঙ্কই জোড়াফুল শিবিরের দিল্লি দখলের স্বপ্ন উসকে দিলো।

মন্তব্যসমূহ