বেহালার দিন প্রতিদিন দুর্গা পুজো বিশেষ সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের চোখে - ' দেবী যখন মমতাময়ী '

 দুগগা  পুজো বিশেষ 

দেবী যখন মমতাময়ী 


- কাজল ভট্টাচার্য 

ম্যাডাম থেকে মমতাময়ী। সবই মহামায়ার ইন্দ্রজাল।
সেদিন ম্যাডামের ইমেজের কাছে হেরে গেছিলো দেবীর ইমেজ। এবার দেবী বাংলার দিদিরূপেণ সংস্থিতা! কখনও সেলুলয়েডের কাছে আবার কখনও রাজনীতির গ্ল্যামারের কাছে গোহারা হেরেছেন মহিষাসুরমর্দিনী। 

দেবী দুর্গা তো মহামায়া। অনন্ত তাঁর রূপ। কখনও উমা, কখনও পার্বতী, আবার দুর্গাও। তিনিই কালিকা কামাখ্যা। তাহলে রূপভেদে দেবীর ম্যাডাম সুচিত্রা সেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হতে বাধা কোথায়? আবার ইন্দিরা গাঁধির মধ্যেও দেবী দুর্গার রূপ দেখতে পেয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি, মকবুল ফিদা হুসেন।
আগে ছিলেন তিনি স্বর্গের দেবী। একচালায় ডাকের সাজে মাদুর্গার চোখজুড়ানো অপার্থিব মৃন্ময়ীরূপ। সেই রূপের সামনে দাঁড়ালে মনে সম্ভ্রম জাগতো। বেশিক্ষণ দেবীর চোখে চোখ মিলিয়ে থাকা যেতো না। এমনই মহিয়সী। মাথা ঝুঁকে যেতো। 
সেই দেবীকে আরও আপন করে পেতে চেয়েছিলেন মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পাল। মর্তে তো দেবীর বাপেরবাড়ি। সেখানে আবার দেবী কিসের? বাপেরবাড়িতে তিনি কন্যা। আলোকদুহিতা। তাই সেই শিল্পী দেবীর রূপবন্দনা করেছিলেন মানবীরূপে। বাংলার ঘরের মেয়ে। ১৯৩৮ সালের সেই ঘটনার থেকেই শুরু হলো দেবীমূর্তির বিবর্তনের ইতিহাস।

দেবীরূপে মানবীদর্শনের ইতিহাস যেমন আছে, তেমন আছে উল্টোটাও। মানবীর মধ্যেই দেবীদর্শন করেছিলেন শিল্পী। আর দেবী যখন মহামায়া, তখন তার রূপের অন্ত থাকবেটা কেন?
এমনিতেও আমাদের দেবদেবীরা মূলত মানুষের মতোই। তবে অধিকাংশই সুদর্শন। দেবত্ব আরোপ করতে কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয় মাত্র। পাশাপাশি থাকে দেবদেবীর বাহন। কারুর বাহন পশু কারুর পাখি।
প্রাচীন মেসোপটমিয়াতেও দেবদেবীর মধ্যে মনুষ্যত্ব আরোপ করার প্রথা ছিলো। মানুষের ধারণা ছিলো, অসাধারণ শক্তির অধিকারী এই দেবদেবীরা। তাঁদের নিয়মিত ভোগ নিবেদন করা হতো। ঠিক যেমনটা আজও করা হয় ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে, এমনকি গৃহস্থের বাড়ির পূজাতেও। স্বর্গবাসী দেবদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ আরও নিবিড় করে তুলতে সেই আদিযুগ থেকেই নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে মর্তবাসী।

শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গার ন'রূপ। তবে এব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। তবে শাস্ত্রের কচকচানি ছেড়ে, পুরাণ- পুঁথি ঘেঁটেও কোথাও দেবীর ম্যাডাম, প্রিয়দর্শীনী বা মমতাময়ী রূপের উল্লেখ পাওয়া যায় না। একথা হলপ করেই বলা যায়। 
দেবী পার্বতীর এই নয়রূপের দর্শন মেলে নবরাত্রি উৎসবে। প্রথমরাতে দেবীর আরাধনা শুরু শৈলপুত্রী রূপে। তারপর ক্রমে ক্রমে ব্রহ্মচারিনী, কাত্যায়নী, কালরাত্রির মতো মোট ন'রূপের শেষে দেবী আবির্ভূতা হন সিদ্ধিদাত্রী রূপে। 
আবার দেবীবরণের সময়কালভেদে একইরূপের দুই নাম। ভারতের গঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকলেই পদ্মা। বসন্তের চৈত্রমাসে লঙ্কেশ্বর রাবণ দেবী পার্বতীর আরাধনা করেছিলেন বলে দেবীর সেই রূপের নাম বাসন্তী। আবার শরতে রামচন্দ্রর অকালবোধনে সেই দেবীই পূজিতা হন দুর্গারূপে। বাঙালিরা যখন দুর্গাপূজায় ব্যস্ত, তখন অবাঙালিরা মাতেন নবরাত্রি উৎসবে। আবার দেবীর জগদ্ধাত্রীরূপ কিন্তু গোটা দেশে বিখ্যাত- মা জগদম্বে।

সাজগোজ করা নারীচরিত্রের এক কোমল প্রবণতা। তবে বিয়েবাড়ির সাজ আর দশটা পাঁচটার অফিসটাইমে ভিড় ঠেলে মেট্রোয় ওঠার সাজে ফারাক থাকে বৈকি। ঠিক সেরকমই মহিষাসুর বধে দেবী পার্বতী যে সাজে আবির্ভূতা হন, রক্তবিজ নিধনে সেই সাজ থাকে না। দেবী তখন ভয়ঙ্করী মাকালী।
আদ্যাশক্তি দেবী পার্বতীর দেহকোষ থেকেই সৃষ্টি দেবী কৌশিকীর। এই কৌশিকী কালোমেয়ের রূপধারণ করে দেবী কালী। আবার দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ কালী। দেবীর ন'টি রূপ থাকলেও আমরা সাধারণত পূজাআচ্চা করি আটটি রূপের।
তবে সেই যে দেবী পার্বতী মানবীরূপে আবির্ভূতা হলেন, তারপর থেকেই কলির হাওয়া লাগলো তাঁর গায়ে। থেকেথেকেই রূপ বদলালেন তিনি। ভক্তের ইচ্ছাপূরণ করতে তিনি কখনও মহানায়িকা তো কখনও প্রিয়দর্শীনী। আর এবারে তিনি সাক্ষাত অগ্নিকন্যার প্রতিরূপ।

দমকলের 'সুচিত্রা প্রতিমা'র কথা মনে আছে? সেটা ছিলো পঞ্চাশ ষাট দশকের ঘটনা। সুচিত্রা সেন তখন বাংলায় চুটিয়ে রাজ করছেন। কলকাতার দমকল কর্মীদের পূজায় মহানায়িকার মুখের আদলে গড়া হলো দেবী দুর্গার মুখ। মৃৎশিল্পী রমেশ পাল। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে দমকলের সেই ঠাকুর দেখতে ভিড় উপচে পড়তো।
তবে গোপেশ্বর পাল সেদিন যা করেছিলেন তার পুরোটাই মনের তাগিদে। প্রাণের বিশুদ্ধ আবেগে। এরপরে দেবীর রূপবদল হয়েছে বাজারের চাহিদা মেনে। মৃৎশিল্পী প্রতিমা গড়েছেন পুজোপার্টির হুকুমে। আবেগের কোনও জায়গা ছিলো না, গোটাটাই চমক।
'বাংলা তার মেয়েকেই চায়।' কয়েকমাস আগের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে শ্লোগান দিয়েছিলো তৃণমূল কংগ্রেস। বাংলার মেয়ে বলতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার সেই শ্লোগানের 'এক্সটেন্ড পার্ট'য়েই, দেবী দেখা দিতে চলেছেন মমতাময়ী রূপে। বাগুইআটির নজরুল পার্ক উন্নয়ন সমিতির এই মূর্তি গড়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন শিল্পী মিন্টু পাল। মমতাময়ী মা দশভুজার হাতে থাকছে না চিরাচরিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের দেওয়া ব্যাকডেটেড অস্ত্রশস্ত্রও। তার বদলে থাকবে মমতা সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্প। তৃণমূল সুপ্রিমোর মঙ্গলময়ী রূপ প্রতিষ্ঠিত করতেই দেবী দুর্গার বাগুইআটি আগমণ।


অতীতে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধির মধ্যেও শক্তিরূপিনী দেবী দশভুজাকে আবিষ্কার করেছিলেন দেশের আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করে ভারত। ভারতের সেই সাফল্য উদযাপন করতেই ইন্দিরাকে দেবী দুর্গা বলে মহিমান্বিত করেন বাজপেয়ি।
তবে ইন্দিরাকে দেবী দুর্গার রূপদান করে চরম বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন। ১৯৭৫ সালে দেশে ঘোষণা হলো জরুরি অবস্থার। নিজের একনায়কতন্ত্র ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়েছিলেন ইন্দিরা গাঁধি। এমন অভিযোগে দেশ যখন অগ্নিগর্ভ, ঠিক তখনই হুসেন তাঁর ক্যানভাসে ইন্দিরাকে এঁকে ফেলেন দেবী দুর্গারূপে। তাঁর সেই ছবি নিয়ে দেশের বড় শহরগুলিতে জমিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেন কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া। ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে মকবুল ফিদা হুসেনকে রাজ্যসভার সদস্যপদ লাভের বর দেন ইন্দিরারূপী দেবী দশপ্রহরণধারিণী।

শাসকের মধ্যে দেবীরূপ দর্শন নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক বাঁধতেই পারে। এমনকি সেই বিতর্ক ছড়াতে পারে সামাজিক স্তরেও। গোটাটাই গিমিক নাকি কোথাও লুকানো আছে মনের আবেগ? পণ্ডিতজন প্রশ্ন তুলতে পারেন নীতি- নৈতিকতা নিয়েও। কিন্তু ঘটনা যদি হয় উল্টোটা? 
মর্তের মানবীতে স্বর্গের দেবীদর্শন। শিল্পের দুনিয়ায় উল্টোপথে হাঁটার মানুষজনও থাকেন। ঠিক যেমনটা ছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য।
সাল ২০২০। দুচোখ মেলে দেবীমূর্তির এক অনন্য মাতৃরূপ দর্শন করেছিল কলকাতাবাসী। বেহালায় বড়িশা ক্লাবের আরাধ্য ছিলেন পরিযায়ীর বেশে মা দুর্গা। কোলে যেন শিশু কার্তিক। সন্তানকে নিয়ে ত্রাণশিবিরে চলেছেন মা। শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য এই মায়ের ছবিতে তুলে ধরেছিলেন এক 'দর্পময়ী'কে। দশভুজার মতোই লড়াই দর্পময়ীরও। শিল্পীর মানসকল্পে সাধারণ এক নারী হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ। তাই 'দর্পময়ী'র কপালে স্পষ্ট তৃতীয় নয়ন।


করোনাকালের প্রেক্ষিতে ভীষণভাবে মানানসই হয়ে 'দর্পময়ী' প্রমাণ করেছিল বিকাশ ভট্টাচার্যের সৃষ্টি ঠিক কতটা কালজয়ী। ছবিটি আসলে ১৯৮৯ সালে শিল্পীর আঁকা 'দুর্গা' সিরিজের। সেই ছবিই মন কেড়ে নিয়েছিল থিমশিল্পী রিন্টু দাশের। ক্যানভাসের 'দর্পময়ী'কে গ্লাস ফাইবারে গড়েন কৃষ্ণনগরের শিল্পী পল্লব ভৌমিক। বিকাশ ভট্টাচার্যের সেই দুর্গা সিরিজে বাড়ির 'কাজের মেয়ে' থেকে নিয়ে সিঁদুর খেলায় ব্যস্ত বঁধু, সবাই ত্রিনয়নী। সমাজের সর্বস্তরের মহিলাদের মধ্যেই দেবীদুর্গার রূপদর্শন করেছিলেন শিল্পী।

কপালে ভাঁজ মহাদেবের। 
গিন্নির রূপে এমনিতেই তিনি সদামুগ্ধ। কিন্তু সেই রূপে কলির বাহার লাগাতেই তিনি উদ্বিগ্ন। এ অবশ্য প্রথমবার না। এরআগে দেবী যখন মহানায়িকার মোহিনীরূপে দেখা দিয়েছিলেন, চাপে পড়ে গেছিলেন শিব। সেযাত্রায় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া গেছিলো। তারপর তো দেবীর বাপেরবাড়ির দেশেই ঝড় উঠেছিল তাঁর রূপে রাজনীতির রং লাগার ঘটনায়। ফুঁসে উঠেছিলেন দেবীর ভক্তরাও। বেশ কিছুদিন শান্তিতে ঘর করার পর ফের চিন্তায় পড়ে গেছেন সদাশিব। 
লক্ষ্মীতো রীতিমত নাচানাচি জুড়ে দিয়েছে। মামাবাড়ির মণ্ডপ হবে 'লক্ষ্মীর ভান্ডার'- এর থিমে। এদিকে আবার লক্ষ্মীর মাকেও রাজনীতির মানুষরা যেভাবে তোল্লা দিচ্ছেন, তাতে শিয়রে সংক্রান্তি দেখছেন দেবাদিদেব মহাদেব। এরপর 'বাঙালির ঘরের মেয়ে' পার্বতী ভোটে দাঁড়াতে চাইলেই সব্বনাশ।

ছবি ও চিত্র সৌজন্যঃ সংগৃহীত 

মন্তব্যসমূহ