বাংলায় দেবী মা কালীর এত ভক্তের সমাগম কেন , বেহালার দিন প্রতিদিন এর একটি বিশেষ প্রতিবেদন

 বাংলার কালীপুজো বিশেষ 


একদিকে ডাকাতদের মাধ্যমে , অন্যদিকে ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচার তাগিদেই দেবী কালিকার পুজার প্রসার এই বাংলায়

  


(
এই বাংলায় কেন এত দেবী কালিকার আরাধনা ? কেনই বা আপামর মানুষের মধ্যে দেবী কালিকা পৌঁছে গেলেন ? সেটা নিয়ে জানার চেষ্টা করলেন সৌমাগ্নি দাস )

বাংলাকে বলা হয় কালীক্ষেত্র। কেন এই ভাবে ভাবা , তার কারণ আর কিছুই নয় , সারা বাংলার আনাচে কানাচে পূজিতা হন দেবী কালিকা । কালীপূজোর ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে গবেষকরা দেখেছেন , এ আজকের দেবী কালীর যে রূপ , বা যে রূপের মুর্তি পুজিত হয় , সেই মুর্তির রূপকার ছিলেন নবদ্বীপের তন্ত্র সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ । বিশিষ্ট গবেষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়ে পূজা করতেন। সেটিও বেশিদিন আগের নয় । বড়জোর চারশো বছর। গবেষকরা বলছেন , আধুনিক কালী মূর্তি পুজিতা হন সপ্তদশ শতকে।  তাই এই ধরণের মুর্তি যে প্রাচীণ নয় , তা বলাই যায়। তবে এটা জানা গেছে , এর আগে তাম্রতটে তান্ত্রিকেরা ইষ্টদেবীর যন্ত্র এঁকে বা সেই যন্ত্র খোদাই করে আবাহন করতেন ।  

‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘ মৃত্যু’। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে "সময়ের থেকে উচ্চতর"। সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, ‘কালী’ শব্দটি ‘কৃষ্ণবর্ণ’ বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। প্রকৃত অর্থে কাল (সময়) কে কলন (রচনা) করেন যিনি তিনিই (কাল+ঈ) কালী । সনাতন ধর্মে ঈ-কারের সৃষ্টি ও শব্দোচ্চারণ-কে উল্লেখ করা হয়েছে ঈশ্বরী বা সগুণ ও নিগুর্ণ ব্রহ্মকে উপলদ্ধি করার জন্য। আবার শ্রীশ্রী চণ্ডীতে উল্লেখ মেলে যে,

'ইয়া দেবী সর্বভুতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে,

নমস্তসৈ, নমস্তসৈ নমো নমোঃহ।'

এই কারণে অনেকেই কালী-কে ক্রোধাম্বিতা, রণরঙ্গিনী বা করালবদনা বলেও অভিহিত করে থাকেন।

দেবীর আর্বিভাব সম্পর্কে পৌরাণিক ব্যাখ্যা ও সনাতন  ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেব লোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় তখন দেবরাজ  ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা পার্বতীর তপস্যা করতে থাকেন, তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত। দেবী কৌশিকী মা মহামায়ার দেহ থেকে নিঃসৃত হয়ে মহাকাল বর্ণ ধারণ করে, যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে ধরা হয়।

সারা বাংলায় নানা রূপে পূজিতা হন দেবী কালীকা । শাস্ত্র মতে  নানা রূপ দেবীর দেখা যায় দক্ষিণকালিকাকৃষ্ণকালীসিদ্ধকালিকাগুহ্যকালিকাশ্রীকালিকাভদ্রকালীচামুণ্ডাকালিকাশ্মশানকালিকা ও মহাকালী আবার কোথাও সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাকালী, মহাভৈরবঘোর ও চণ্ডকালী , ডম্বরকালী, রক্ষাকালী, ইন্দীবরকালিকা, ধনদকালিকা, রমণীকালিকা, ঈশানকালিকা, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ও সপ্তার্নকালী। বাংলার মন্দিরে মন্দিরে আবার নানা নামে পূজিতা দেবী । কোথাও মা ভবতারিণী , কোথাও মা  সিদ্ধেশ্বরী , আমার মা আনন্দময়ী নামেও পূজিতা হন দেবী। 

ফিরে আসা যাক আগের কথায়। এই বাংলায় কোনায় কোনায় কেন ছড়িয়ে পড়ল দেবী কালীকার আরাধনা। এটি কিন্তু কোন সাধক বা তান্ত্রিকের মাধ্যমে নয়। হয়ত শুনতে অবাক লাগবে , এটি একেবারেই কাকতালীয় ভাবে ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচবার তাগিদেই গ্রামের কোনায় কোনায় দেবীর আরাধনা।

একটু দেখা যাক এর পিছনে কি কি যুক্তি আছে গবেষকদের কাছে। সাধারন্তঃ অনেকে মনে করেন অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ অথবা উনিশ শতকের প্রথম ভাগে জমিদারি প্রথার বিলোপ হতে চলেছে , ইংরেজ রাজত্বে সামন্তদের লাঠিয়াল আর তাঁদের দিয়ে লুঠেরা দল তৈরি থেকেই জন্ম নেয় বাঙ্গালী ডাকাত । এর আগে ডাকাত মানে মগ জাতীয় দস্যুদের কথাই সামনে আসে। কিন্তু বাঙ্গালী লুঠেরা সৃষ্টি হয় একেবারে জমিদার ও সামন্ত শ্রেণীদের হাত ধরেই।  

কিন্তু এই সব ধনবান সামন্ত বা জমিদারদের অর্থ লুঠ করবার জন্যও আরেক ডাকাতের দল তৈরি হয়। এদের মধ্যে ডুমুর দহের বিশ্বনাথ রায় বা বিশে ডাকাত , রঘু ডাকাত , গগন ডাকাতের কথাতো কিংবদন্তী । চিতু ডাকাতের কথাও ইতিহাসে জানা যায়। নীল বিদ্রোহের  সঙ্গে প্রতিবাদের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে বিশু ডাকাতের নাম।

কেন ডাকাতদের সঙ্গে দেবী কালিকা জড়িয়ে গেলেন ? অনেক গবেষক মনে করেন যে নিজেদের আত্মবলিদান বা আত্মনিবেদন করে ডাকাতি করতে বেরোতেন ডাকাতরা। এদের অনেকেই দেবীকে রক্ষাকর্ত্রী যেমন ভাবতেন , তেমনি ভাবতেন , যে কাজে তাঁরা যাচ্ছেন , সেই কাজকে সফল করতে শক্তি যোগাবেন দেবী। এখানে তিনি মা হিসেবে সন্তানকে নিরাপত্তা দেবেন। রাতের অন্ধকারে ডাকাতেরা যখন ডাকাতি করতে যেতেন , সেই সময় দেবী কালিকার আরাধনা করতেন । এদের মধ্যে অনেকেই দেবীর কাছে নিজের বুকের রক্ত উৎসর্গ করতেন । তাঁদের পরনে থাকত রক্ত বস্ত্র। অন্তরে থাকত আধ্যাত্মিকতা । তাঁরা অনেকেই বৈষ্ণব মতে দেবীর আরাধনা করতেন । কিন্তু এই সব ডাকাতদের সঙ্গে সামান্য নৃশংসতা জড়িয়ে যেতে , আর দেবীর করাল রুপের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকায় , দেবীর ভয়ংকরতার সঙ্গে ডাকাতদের পরিচয়ের ভয়ংকর রূপ সম্পৃক্ত হয়ে যায়। 

এদিকে এই রূপ সারা বাংলার গ্রাম গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। আর ভালো ডাকাতদের সঙ্গে দুর্বৃত্ত লুঠেরাদের পরিচয় মিলিয়ে দেবার একটা চেষ্টা চলতে থাকে। দেখা গেছে , যে সব বাঙ্গালী ডাকাতদের ইতিহাসে পরিচয় পাওয়া গেছে , তাঁরা অধিকাংশই শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমনে ডাকাতি করতেন। ফলে বিশে ডাকাতদের নামে কেপে উঠত ব্রিটিশ শাসকরা । পরবর্তীতে আরো দেখা গেছে নানা স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দেবী কালিকার মন্দিরকে তাঁদের বিপ্লবের সাধনা ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আর সেখান থেকে দীক্ষিত করা হত বিপ্লবীদের। আর তাঁরা শপথ নিতেন , দেবী কালিকার পায়ে নিজেদেরকে উৎসর্গ করার মধ্যে দিয়ে , দেশ মাতৃকার স্বাধীনতায় নিজেদেরকে বলি দিতে। এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন , এখনও ইতিহাস ঘাটলে ব্রিটিশ পুলিশের খাতায় সমস্ত বিপ্লবীদের পরিচয় ছিল ডাকাত। 

যাই হোক , একটি মিথ চালু আছে যে আমাবস্যার রাতে মা কালীকে পুজো করেই ডাকাতি করতে বেরত ডাকাতরা । এরপর তাঁরা ডাকাতি করে যা পেত , তা এসে বিলিয়ে দিতেন গ্রামবাসীদের মধ্যে। এখনও দাইহাটের ডাকাত কালী মন্দিরে গেলে এই শোনা যাবে , বা বিশু ডাকেতের কালী মন্দির , মঙ্গলকোটের রসুনিয়ায় গেলেও শোনা যাবে এমন সব কাহিনী।

কিন্তু কেন সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল কালী পুজোর রেওয়াজ ? 

গবেষকরা দেখেছেন , ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচতেই সাধারণ মানুষের ঘরে শুরু হয়েছিল কালী আরাধনা। কেননা যেখানে কালী আরাধনা হত , সেই বাড়িতে এসে দকাতি করত না ডাকাত দল। এরকম ডাকাতি না করে ফিরে যাবার ঘটনা লোক মুখে ছড়িয়ে পড়ার পর , গ্রামে গ্রামে কালীপূজোর চল শুরু হয় । এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় , মা সারদার তেলেভোলার মাঠের সেই কাহিনী। বহু মাইল পথ পেরিয়ে মা সারদা কামারপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বর যেতেন পায়ে হেটে। এই মাঠ পড়ত যাবার সময়। এই মাঠেই ছিল সাগর সাঁতরা ওরফে ভিম সর্দারের আস্তানা। মা সারদার দলের ওপর হানা দিতেই , মা সারদা তখন মনে মনে স্মরণ করেন মা ভবতারিনি ও ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণের । এই সময়ে ভিম ডাকাত , মা সারদার মধ্যে দেবী জগত জননীর রূপ   দেখতে পান। মায়ের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। আর খেতে দেন নানা খাবার। আর মেয়ে রূপে দেবী কালিকে প্রতিষ্ঠা করেন মন্দিরে। আজো এই কালী পুজোয় ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় সেদিন যে যে খাবার মা সারদাকে দেওয়া হয়েছিল।  

বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে নানা কালী মাহাত্ম। অনেকে বলেন এই বাংলায় জন্ম নিয়েছেন অনেক সাধক। আর তাঁদের হাত ধরেই নাকি এই বাংলায় কালী সাধনার প্রসার। সাধারনতঃ শক্তির আরাধনা হিসেবে কালীকেই বেশি করে নিজেদের করে নিয়েছে বাংলার কালী সাধকেরা। আর অন্য দিকে শৈব থেকে শাক্ত , তন্ত্র সাধক থেকে বৈষ্ণব । সব সাধকদের মধ্যে একটি যোগসুত্র হিসেবে দেবী কালিকার উপস্থিতি । দেবীকে উচ্চ কোটি থেকে নিম্ন কোটির মানুষদের কাছে তাই এই বাংলায় দেখা গেছে মাতৃ রূপে রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে ।


মন্তব্যসমূহ