বেহালার দিন প্রতিদিন রবিবাসরীয় বিশেষ কাজল ভট্টাচার্যের কলমে - ' দানবিদায় '

 রবিবাসরীয় বিশেষ 

দানবিদায়



- কাজল ভট্টাচার্য

তাদের দান কিভাবে ভুলি? 
অনেকেই ভুলতে পারেন না। প্রণব রায় সেই দানকে অমরত্ব দিয়েছিলেন, গান বেঁধে। রবীন মজুমদারের সুরে, ফিরোজা বেগমের গলায় সেই গান শুনে মজেছিলো রসিক বাঙালি।
- 'এই কিগো শেষ দান
বিরহ দিয়ে গেলে।"
আমার কলমে সেই জোর নেই। কালি নেই সেই রসবোধেরও। তবে দানগ্রহিতা আমিও। সেই উদার দিল দাতারা আমার জীবনে বারেবারে এসছেন। অদ্ভুত ভাবে বিদায়ও নিয়েছেন। তাঁরা নিজেরাও হয়তো বোঝেননি আমাকে কী সম্ভার দান করে গেলেন। 
এ যেন মেঘ না চাইতেই জল!
মুখফুটে চাইতেও হয়নি। চাওয়ার আগেই দুহাত ভরে দিয়েছেন তাঁরা। খটখটে নির্জন দুপুরে কিছু শুকনো পাতা ঝরার চাপা আর্তনাদ। পাতা হারিয়ে মলিন লতার কেঁপে ওঠার মতো আমি, বর্ষামুখর সেই রাতে। সোহাগসিক্ত রাতদুপুরের সেই শতসহস্র টেক্সট। স্মৃতির ইনবক্সে জমাখাতায় বন্দি কতো রাত। আরও কতো কী!
এক থেকে চাঁদের ষোলো কলা। সব কলাই হার মানে তার ঠোঁটের ওপর ওই তিলের রূপে। বাতাসের ঝাপটায় এলোমেলো চুলে তারার খেলা। আলো আঁধারিতে সোহাগে ঢাকা মুখ। হাতের চুরির রিনিরিনি। কতো মান অভিমান। ধুলোয় গড়াগড়ি খাওয়া কিছু অঙ্গীকার। সব দিয়ে গেলেন তাঁরা। এতো দানসামগ্রী তাও এক জীবনে! মুশকিল হলো রাখিটা কোথায়?
এসবই তো, 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়।'
সবকিছুই তাঁরা জেনেশুনে দিয়েছেন। প্রেমের অভিষেকে কোনও সনদ ছিলো না। তবু দুহাত উবুড় করে দান দিয়ে গেছেন। তবে সে দান আমি দুহাত পেতে নিইনি। ঘাড় ধরে দিয়েছে। তবু তাকে দানই বলবো। তার নগদ মূল্য চোকাতে হয়নি। মূল্য চোকাতে হয়েছে অন্যভাবে।
তবে বুক ঠুকে একথা বলতেই পারি, তাঁরা আমাকে সমৃদ্ধ করে দিয়ে গেছেন।
অফিস আঁকা লেখার বাইরে যে বিশাল ব্যাপ্তি জগতটার, তাঁরাই চিনিয়ে দিয়ে গেলেন। দিনের পর দিন তাঁদের দেখেছি। তাঁদের হাত ধরে হেঁটেছি রাজপথ থেকে কানাগলির পথ। পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থেকেছি ময়দানে, বাগবাজার ঘাটে। এঁরাই আমার দানকর্তা।
আমার অবস্থাটা ছিলো মুখে ফাতনা আঁটা মাছের মতো। ছটফট করেছি একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য। লড়াই চালাতে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে এসেছে। তবুও লড়াই চালিয়ে গেছি। যখন ফের জলের মাছ জলে ফিরে যেতে পেরেছি, সবাইকে সেই গল্প শুনিয়েছি। খোলা আকাশের নীচের গল্প। মাছ শিকারিদের কথা। নিষ্ঠুরতার কাহিনী। দান গিলতে আমার সেই হাঁসফাঁস অবস্থা। দানের কাঁটা না পারি গিলতে, না ওগড়াতে। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি'র কথা।
'কাঁটা দিয়ো না। যাহাকে তুমি ভালবাসো তাহাকে ফুল দাও।' বলেছিলেন রবিঠাকুর। 'হৃদয় সরোবরের পদ্ম দাও, পঙ্ক দিয়ো না।' 
বাঙালিমাত্রই রবীন্দ্রপ্রেমিক। তাই ফুল দিয়েই ছাড়বে। তবে ফুলের আড়ালে থাকবে কাঁটার খোঁচাটাও। ওটা ফাউ। পদ্মের পাপড়িতে থাকবে পঙ্কের ছোপ। আবেগের আখরে বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে লেখা থাকবে বিদায়বেলার কিছু শব্দ, কতো কথা। কেন এই বিপুল দান? এই দানের বহরে আমার প্রাণ যে ওষ্ঠাগত? 
জবাব একটাই- ইউ ডিজার্ভড ইট।

তাঁদের ঋণশোধের জন্য শব্দের পর শব্দ সাজিয়েছি। গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতো! তাঁদেরই দেওয়া দানে তাঁদের অনুভব। সেই অনুভবই আমার সরস্বতীর ভাণ্ডার। সহায় সম্বল পূঁজি।
দাতাদের নাম গোপন রাখার শর্তও মেনেছি অক্ষরে অক্ষরে। লিখেছি শুধুই তাঁদের মহানুভবতার কাহিনী। নিজেদের সেই কীর্তির কথা তাঁরা নিশ্চয়ই পড়েছেন। মনে মনে মুচকি হেসেছেন। ভেবেছেন- কেমন দিলাম!
তৃপ্তির এক চিলতে ওই মুচকি হাসিটাই বা কম কীসে? সামর্থ্য আমার সীমিত। আমি নাহয় ওটুকুই দিলাম। কিছু দিতে পারার ওই অনুভব লাখ টাকার। 
শুকনো মনটা নিয়েই ফিরেছিলাম। ভেজা মনটা লেপটে ছিলো বিছানার চাদরে। 'বিছানায় পরে থাকা ভেজা মনটা' গুলজার সাহেব ফেরত চেয়েছিলেন। আমি চাইনি। তবে শ্যামল মিত্রের মতো যদি বলতে পারতাম- 'যাক, যা গেছে তা যাক', তাহলে বেশ হতো। মুখে বলা বড্ড সোজা। বুকের গভীর থেকে বলা ততটাই কঠিন।
'সব জগ শোয়ে হম জাগে
তারো সে করে বাঁতে
হো চাঁদনি রাতে চাঁদনি রাতে...'
ভেসে আসে স্মৃতির অতল থেকে বেগম নূর জহাঁর সেই অমরগীতি।
অপলক তাকিয়ে চন্দ্রদেব। আকাশে চন্দ্র, ধরায় আমি। দুজনেই দুজনকে দেখার নেশায় কেমন বুঁদ হয়ে যাই। সেই রাতে চাঁদের আলোয় ফড়িং ওড়ে। তারারা নেমে আসে নীচে। সরোবরের হিমশীতল নিস্তব্ধতা ভেঙে, ঘাই মারে রুই কাতলা। চাঁদনির জোয়ারে ভাসছে শরীর। দুটি শরীর। একটা আমার, আরেকটা চাঁদের। দুটো শরীরই ক্ষতবিক্ষত, কলঙ্কের দানে।।

(ঋণস্বীকার: গুলজার সাহেবের 'মেরা কুছ সামান')
চিত্র সৌজন্যঃ সংগৃহীত

মন্তব্যসমূহ