রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

 

 রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ২৪     



সন্দীপ চক্রবর্তী


কিন্তু বাড়ির নাম রাখা সহজ হলেও কলকাতা শহরের হাজার হাজার বাড়ির ভিড়ে আমাদের সেই ছোট্ট সুন্দর বাড়িটাকে খুঁজে বের করা তত সহজ নয়। কোথায় আছে আমাদের ছুটি? সারাদিন অফিসে কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই খবরের কাগজে জমি-বাড়ির বিজ্ঞাপনে চোখ রাখি। চেনাশোনা দু'একজনকে বলেওছি ফ্ল্যাটের কথা। কিন্তু সেখানেও সমস্যা আছে। মাত্র এক বছর চাকরি করছি। এত অল্প সময়ে কতটুকুই বা টাকা জমাতে পেরেছি? নিজেদের পুঁজি যত কম হবে ব্যাঙ্কলোনের অঙ্কটা তত বাড়বে। প্রত্যেক মাসে মোটা টাকা ইএমআই দিতে হবে। সে দেব'খন। আগে ফ্ল্যাটটা তো চোখে দেখি।
একদিন রুরু বলল, 'ডোনট ওয়ারি অর্জুন। ড্যাড ক্যান গিভ আস দা মানি। হি উইল নট বদার ফর সাচ আ স্মল অ্যামাউন্ট অফ মানি টু বাই হাউস ফর হিজ ওনলি ডটার অ্যান্ড সন ইন ল।'
কথাটা আমার পছন্দ হল না। বাবা বলত, 'আমাদের কোনও চাওয়া যদি খুব সহজেই মিটে যায় তা হলে তার প্রতি কোনও মায়া থাকে না। চাওয়ার জিনিসটা যাই হোক আমরা তাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড হিসেবে দেখি। কিন্তু কোনও সাধ পূরণের জন্য যখন আমাদের স্ট্রাগল করতে হয় তখন তার প্রতি একটা মায়া তৈরি হয়। আমরা সারাজীবন তাকে সন্তানের মতো আগলে রাখি।'
ছুটি তো আমাদের সন্তানই। তাকে পাওয়ার জন্য কেন আমরা স্ট্রাগল করব না? বললাম, ' না রুরু। ছুটি আমাদের বাড়ি। আমি চাই সে আমাদের এফর্টেই তৈরি হোক। তুমি হয়তো ভাবছ সময়মতো বাড়ি খুঁজে না পেলে একুশে জানুয়ারি পিছিয়ে যাবে। না, তা হবে না। আমি তো ভালোই স্যালারি পাই। অসুবিধে হবে না।'
'টাকাটা তুমি লোন হিসেবে নিতে। পরে সুবিধামতো শোধ করে দিলেই চলত।'
ঠাট্টা করে বললাম, 'আই ডোনট নো এনি সাচ সন ইন ল হু হ্যাজ টেকেন লোন ফ্রম হিজ ফাদার ইন ল অ্যান্ড রিপেইড। ভবিষ্যতে হয়তো আমারও মনে হবে যে উনি তো ওঁর মেয়েকেই দিয়েছেন তা হলে আমি মিছিমিছি টাকাটা ফেরৎ দিতে যাব কেন? সেদিন ওঁর কাছে তো বটেই, নিজের কাছেও আমি খুব ছোট হয়ে যাব। না রুরু, তা হয় না।'
রুরু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, 'কী জানি বাবা! আমাদের এক্সপিরিয়েন্স নেই, এই অবস্থায় আমরা যদি বড়োদের হেল্প নিই তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়!'
'হেল্প নেব তো। আঙ্কলের তো অনেক জানাশোনা। ওকে বলো ভালো কোনও এরিয়ায় একটা ফ্ল্যাট খুঁজে দিতে। বাজেট ধরো আট-দশ লাখ।'
সে সময় আট-দশ লাখ বেশ বড়ো অ্যামাউন্ট। ৷ রুরুর চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া নামল, 'এত টাকা তুমি কোথা থেকে পাবে? তুমি যদি খেলাঘর বিক্রি করার কথা ভাবো তা হলে বলব, সেটি হবে না। খেলাঘর বিক্রি করা যাবে না।'
খেলাঘর নিয়ে রুরুর এই পিছুটান আমার ভারী ভালো লাগল। বিবাহ নামক যে বন্ধনে নারী আর পুরুষ বাঁধা পড়ছে যুগ যুগ ধরে তাতে পুরুষটির কিছুই বদলায় না। মেয়েটির মাটির রং বদলায়, হাওয়ার স্পর্শ বদলায়, আলোর বৃত্ত বদলায়। সে নিজেও অনেকটাই বদলে যায়। এতদিন সে বাবার ছায়া ঘেরা উঠোনে কণকচাঁপা হয়ে ফুল ফোটাচ্ছিল। একদিন হঠাৎ গন্ধরাজের হাত ধরে তার বুকে মাথা রেখে মেয়ে-গন্ধরাজ হয়ে গেল। এখন থেকে ওর মনের কোনও নিভৃত কোণে কণকচাঁপা আপনমনে ফুটবে। মেয়েটি হয়তো তার কোনও খবরও রাখবে না। কিন্তু কণকচাঁপার গন্ধে ভরে যাবে গন্ধরাজের ঘর। ঠিক যেমন রুরুর উষ্ণ স্পর্শে ভরে যাচ্ছে খেলাঘর। এক পাগল আর এক পাগলিকে হারিয়ে যে শূন্যতা তার বুকে জমেছিল রুরুর একটি কথায় সব একেবারে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। খেলাঘর বুঝে গেছে আবারও এক পাগলির পাল্লায় ওকে পড়তে হবে। পাগলদের হাত থেকে ওর নিস্তার নেই। বললাম, 'ছুটিতে যারা থাকবে তাদের তো একটা খেলাঘর থাকতেই হবে রুরু। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো খেলাঘর আমিও বিক্রি হতে দেব না।'
'তা হলে অত টাকা কোথা থেকে আসবে?'
'ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেব। তারপর মাসে মাসে শোধ করব।'

ফ্ল্যাট খোঁজার গতিতে প্রাণ এল। কলকাতা শহরে কোনওদিন নিজের বাড়ি হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি৷ যখন যেখানে জায়গা পেয়েছি থেকেছি। তাই যে-ফ্ল্যাট কিনব সেটা কেমন হবে তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা ছিল না। একটা কিছু হলেই হল। আমি দেখেছি বেশিরভাগ পুরুষমানুষের কাছে বাড়িটা হল খাবার আর শোবার জায়গা। কিন্তু মেয়েদের কাছে তা নয়। মেয়েরা বাড়িকে সাজায়, গোছায়। ঘর করে তোলে। একটি মেয়ের সারাজীবনের সাধনার ছবি ফুটে ওঠে তার বাড়িতে। তার সংসারে। কথাটা হয়তো মধবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বেলায় বেশি খাটে। সমাজের উঁচুমহলে যাদের বসবাস তাদের কাছে বাড়ির সংজ্ঞাটা অন্যরকম। তাদের কাছে বাড়ি নেহাতই প্রপার্টি। কিংবা নিছকই রেসিডেন্সিয়াল অ্যাড্রেস৷
আশ্চর্যের ব্যাপার হল রুরু আজন্ম বিলাস-বৈভবের মধ্যে বড়ো হয়েও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের মতো জিদ করে বসল। আমার অবান্তর চিন্তায় বিরক্ত হয়ে বলল, 'যা হোক একটা কিছু হলেই হল না, বুঝলে! ফ্ল্যাট কেউ রোজ রোজ কেনে না। তিনটে বেডরুম থাকতেই হবে। আর সাউথ ফেসিং ব্যালকনি না থাকলে কেমন যেন পায়রার খোপের মতো লাগে। উঁহু, ওরকম চলবে না।'
আমি আতান্তরে পড়লাম। বাজেট ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণের বারান্দা না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু তিনটে বেডরুম? বললাম, 'তিনটে বেডরুম কী হবে রুরু? মানছি আঙ্কল আর আন্টি মাঝে মাঝে আসবেন। তার জন্য তো দু'টোই যথেষ্ট।'
'আজ্ঞে না। তিনটেই চাই।'
'কিন্তু কেন চাই সেটা তো বলবে!'



কথা হচ্ছিল বালিগঞ্জ লেকে বসে। হাতে চিনেবাদামের ঠোঙা। চোখে সুন্দর একটা জীবনের দোসর হবার স্বপ্ন। অনেকক্ষণ রুরু কিছু বলল না। শেষ বিকেলের মন খারাপ করা আলোর রং লেগেছে লেকের জলে। এই আলোকে কনে দেখা আলো বলে। যার সিঁদুরে লাল মায়ায় স্তব্ধ হয়ে গেছে রুরু। কোনও কথাই বলছে না। জলের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে আছে৷ আমি অপেক্ষা করছি। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছি রুরু নিশ্চয়ই আমাদের বাচ্চার কথা ভাবছে। সে বড়ো হলে তার জন্য একটা ঘর চাই। কিন্তু যেটা বুঝতে পারছি না সেটা হল, আমরা তো প্রথম তিন বছর বাচ্চা নেব না বলে ঠিক করেছি। তা হলে এখনই আলাদা ঘরের কী দরকার! পরে অর্থনৈতিক ভিত আরেকটু মজবুত হলে ছোট ফ্ল্যাট বিক্রি করে বড়ো একটা কিনলেই চলবে। যাই হোক, একসময় রুরু ফিরল। ফিরল কথাটাই ভালো। কারণ এতক্ষণ ও এই পৃথিবীতে ছিল বলে আমার মনে হয়নি। লেকের জল থেকে চোখ না সরিয়ে রুরু বলল, 'তিন নম্বর ঘরটায় আমার শ্বশুরমশাই আর শাশুড়িমা থাকবেন।'
আমি অবাক। মানুষের আবেগকে আমি শ্রদ্ধা করি। কারোর মধ্যে আবেগ দেখলে আমার মাথা আপনা থেকেই নত হয়ে আসে। কিন্তু বাস্তবের কথাও আমাকে ভাবতে হয়। নিদারুণ একটা অস্বস্তি মেনে নিয়েই বললাম, 'রুরু ওরা তো নেই। তা হলে--'
আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে রুরু বলল, 'ওরা আছেন অর্জুন। থাকবেনও। আমি তাই বিশ্বাস করি।'
'কিন্ত--'
'প্লিজ অর্জুন। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিন ভারী সুন্দর একটা ইচ্ছে হয়েছিল৷ কোনও কোনও মেয়ে যেরকম বিয়ের পরেই একটা কমপ্লিট ফ্যামিলি পায়, আমিও সেরকম পাব। কিন্তু তা তো আর হল না। তাই ইচ্ছেটা এমনি করে মেটাব। তুমি আপত্তি করো না।'
মনে হল আমার চোখের সামনে রুরু একটা গাছ হয়ে যাচ্ছে। যে গাছ ছায়া দেয়। আশ্রয় দেয়। আমার বাবা-মা--অথচ আমি তাদের কথা এইভাবে ভাবতে পারিনি। অবশ্য পারবই বা কী করে! আমি তো আর গাছ নই। সুসন্তান হতে না পারার গ্লানি ঢাকা পড়ল রুরুর ছায়ায়। বললাম, 'তাই হবে রুরু। আমাদের ফ্ল্যাটে তিনটে বেডরুমই থাকবে।'

(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ