রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

  রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ২৭       



সন্দীপ চক্রবর্তী


অমল যোগলেকরের ফোনকে আমি গুরুত্ব দিইনি। শুধু ঘুলঘুলিতে দুটি কপোত কপোতির মিলন মুহূর্তে বাড়ির গিন্নির ছুঁড়ে দেওয়া গরম জলের মতো অমল আছড়ে পড়েছিল বলে হতাশ হয়েছিলাম। আমার মতো মধ্যবিত্তের জীবনে বালুচরীতে মোহময়ী রূপ ধারণ করে জীবন তো বড়ো একটা আসে না। ব্যাস এইটুকুই। তুমি তো জানো কুমুদিনী, মানুষ মানুষের কাছে আসতে চাইলে আমি তাকে বাধা দিই না। লিঙ্গবিচারে আমি পুরুষ আর রুরু মহিলা হলেও, এটাই তো আমাদের সম্পূর্ণ পরিচয় নয়। আমরা মানুষ আর সেটাই আমাদের সম্পূর্ণ পরিচয়। তা হলে আমি অমলকে বাধা দেব কেন? সন্দেহই-বা করব কেন? না, আমি সন্দেহ করিনি। সিমলিপালে যে ক'দিন ছিলাম অমল ফোন করেছে। রুরুর ফোন সুইচড অফ থাকলে আমার ফোনে করেছে। অম্লান বদনে আমি ফোনটা এগিয়ে দিয়েছি রুরুর দিকে। ওরা কথা বলেছে আর আমি সিগারেটে সুখটান দিয়েছি।

সেকেন্ড হনিমুন কাটিয়ে আমরা সিমলিপাল থেকে লোথালে ফিরে এলাম। একবিংশ শতকে ধর্মযুদ্ধ নয়, বনবাসের পর অপেক্ষা করে আমাদের জীবনযুদ্ধ । অফিসে কাজের চাপ যেন এক ঝটকায় অনেকটাই বেড়ে গেল। অ্যাকাডেমিক জগতের কাজ। ভালোবাসার কাজ। চাকরি করছি বলে মনে হয় না। সুতরাং বাড়ি ফেরার সময়ের কোনও ঠিক নেই। দশটা..এগারোটা..কোনও কোনওদিন বারোটাও হয়ে যায়। আগেকার মতো ন'টার মধ্যে বাড়ি ফেরা তখন আমার কাছে একটা ইলিউশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লোথাল

কিন্তু রুরু আমার দেরি করে ফেরা নিয়ে কোনও অনুযোগ করত না। আগে যেমন একাকিত্বের কারণে ওর চোখে স্থায়ী একটা ক্লান্তির ছায়া ফুটে থাকত তাও আর দেখতে পেতাম না। সব যেন কোন এক ভোজবাজিতে উধাও হয়ে গেছে। প্রথমদিকে আমি ভেবেছিলাম রুরু বোধহয় আমার এই ব্যস্ত শেডিউলের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছে। উপায়ান্তর না পেয়ে মেনে নিয়েছে আর কী! বিশ্বাস করো কুমুদিনী, এই ভাবনা আমাকে মুহূর্তের জন্য শান্তি দেয়নি। বরং যখনই কথাটা মনে পড়ত অপরাধবোধে ভুগতাম। যেন আমারই অপারগতার জন্য রুরু এই নিদারুণ কষ্ট মেনে নিয়েছে। কিন্তু তা নয় কুমুদিনী। ভুল ভাঙল অচিরেই।

একদিন আমার খুব মন খারাপ। রুরুর কথা ভেবেই মন ভালো নেই। বাড়ি ফিরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম, 'রোজ ফিরতে দেরি হয়ে যায় বলে আমি মারাত্মক অপরাধবোধে ভুগি রুরু। তুমি সারাদিন বাড়িতে একা থাকো। দিনের পর দিন এইভাবে থাকলে মানুষ ডিপ্রেশনে চলে যেতে বাধ্য। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও আমি তোমাকে সময় দিতে পারি না।'

রুরু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, 'আয়াম অলরাইট অর্জুন। আজকাল আর আমার অসুবিধে হয় না।'

'অসুবিধে হয় না? নাকি, সব অসুবিধে তুমি মেনে নিয়েছ? আমার তো মনে হয় তুমি আশা করাই ছেড়ে দিয়েছ। অন্তত আমার কাছে তোমার আর কোনও আশা নেই।'

'এ মা, না না। আসলে অমল রোজ ফোন করে তো। কোনও কোনওদিন তো দিনে তিন-চারবার করে। ও আছে তাই আমার একা লাগে না।'

না, আমার কোনও ঈর্ষা হয়নি। রাগও না। এমনকী আমি কোনও অশনি সংকেতও পাইনি। বরং আমার মনে হয়েছিল বন্ধু তো বন্ধুকে ফোন করতেই পারে। একবারও মনে পড়েনি অমল রুরুর বন্ধু ঠিকই কিন্তু সাধারণ বন্ধু নয়। রুরুকে বিয়ে করতে চেয়েছিল অমল। আমি এসে যাওয়ায় পারেনি। আমার ব্যস্ততা এবং রুরুর একাকিত্বের সুযোগ নিয়ে ও কি সেই না-পাওয়ার প্রতিশোধ নিতে পারে না? এসব খুবই সাধারণ ভাবনা। কিন্তু তখন আমার মাথায় আসেনি। আর তার ফল কী হয়েছিল?

জানো কুমুদিনী, বিয়ের সময় প্রত্যেক নারী ও পুরুষকে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে কয়েকটা প্রতিজ্ঞা করতে হয়। বড়ো সুন্দর রীতি। অগ্নি সারাজীবন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দম্পতিকে আলো দেখায়, মনে করিয়ে দেয় প্রতিজ্ঞার কথা। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সারাজীবন রুরুকে ভালোবাসব। ওকে সুখী করব। কিন্তু ভালোবাসলেও রুরুকে সুখী আমি করতে পারিনি। আলোটা সরে গিয়েছিল বোধহয়। নয়তো আমিই অন্যকিছুর মোহে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আর সেই সুখ না থাকার অ-সুখে শুশ্রূষার নৈবেদ্য নিয়ে রুরুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল অমল। নিজের সাবেক যে সত্তাকে ভয় পেত রুরু, বারবার বলত, পুরনো রুরু ফিরে এলে সব তছনছ হয়ে যাবে--সেই সত্তাকেই জাগিয়ে দিয়েছিল অমল। তারপর এল সেই দিন।

সেদিন যখন বাড়ি ফিরলাম তখন রুরু ফোনে অমলের সঙ্গে কথা বলছে। বাড়িতে সারাদিনের কাজের লোক সেদিন কী কারণে যেন ছুটি নিয়েছে। রুরু দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে চলে গেল। অবাকই হলাম। কারণ একই রকম পরিস্থিতিতে এর আগে রুরু 'এখন রাখছি। পরে কথা হবে' বলে ফোন রেখে দেয়। অনেকবার এরকম ঘটেছে। কিন্তু সেদিন অন্যরকম হল। পোশাক পালটে, হাতমুখ ধুয়ে আমি সোজা ডাইনিং হলে চলে গেলাম। আমার ফিরতে দেরি হয় বলে, আমি ফেরা মাত্র রুরু ডিনার সার্ভ করে। আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু সেদিন রুরু কথা বলতেই থাকল। আমি ভেবেছিলাম খুব জরুরি কথা বুঝি। পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর শুনতে পেলাম রুরু বলছে, 'এখন রাখছি। অর্জুন এসে গেছে।'

ডাইনিং হলে এসে রুরু বলল, 'সরি। আমার একটু দেরি হয়ে গেল।'

'অমল ঠিক আছে তো?'

'ওর আবার কী হবে! হি ইজ অ্যাবসোলিউটলি ফাইন। বর্ধমানের কোন এক গ্রামে ফার্ম হাউজ করেছে। সেখানে বাবুর এখন চিড়িয়াখানা করার শখ হয়েছে। পারমিশন নেওয়া হয়ে গেছে। আমরা এতক্ষণ চিড়িয়াখানায় কোন কোন অ্যানিম্যালস রাখা হবে তার প্ল্যান করছিলাম।'

রুরুর ব্যবহারে দুঃখ আগেও পেয়েছি কিন্তু সেদিন অপমানিত বোধ করেছিলাম। যাকে ভালোবাসি সে যদি অপমান করে তার দুঃখ বড়ো মারাত্মক। বারবার মনে হচ্ছিল দিনের শেষে বাড়ি ফিরে একটা মানুষ ক্লান্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় অপেক্ষা করছে জানার পরে রুরু কি পারত না ওদের চিড়িয়াখানার গল্পটা একটু ছোট করতে? দায়িত্ববোধ বিসর্জন দিয়ে কেউ যদি দায়িত্ব পালন করে তা হলে সেটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। রুরুর মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করা, টেবিলে সার্ভ করা দেখে সেদিন আমার তাই মনে হয়েছিল। কবে থেকে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে গেল রুরু? এ কি শুধুই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নাকি ওকে আমার সময় দিতে না পারার প্রতিশোধ?

না, সেদিন আমি ওকে এসব প্রশ্ন করিনি। করার মতো মানসিকতাও ছিল না। খাওয়ার পর চুপচাপ শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সারারাত ঘুম আসেনি। রুরুর অবশ্য সুনিদ্রায় কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানো কুমুদিনী, বাথরুমে যাবে বলে রুরু সেদিন একবার উঠেছিল। ও জানত আমি জেগে আছি। অন্য সময় হলে বারবার জানতে চাইত কেন আমি ঘুমোইনি? কিন্তু সেদিন একটি কথাও বলেনি। বাথরুম থেকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

দুদিন পরেই ছিল রবিবার। প্রত্যেক রবিবার আমাদের লং ড্রাইভে যাবার কথা তো তোমায় আমি বলেছি। সারা সপ্তাহ আমি উন্মুখ হয়ে থাকতাম রবিবারের জন্য। রুরুও থাকত। কিন্তু সেদিন রুরু বলল, 'আজ আর বেরোব না বুঝলে। অমল দুপুরে ফোন করবে বলেছে। বাইরে থাকলে ওর কথা আমি শুনতে পাব না।'

'কী বলছ তুমি রুরু! সারা সপ্তাহ আমি সময় পাই না। তোমার সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করার জন্য এই রবিবারটাই আমার সম্বল। আজ অন্তত অমলকে আমাদের মাঝখানে এনো না।'

'কী করব বলো! একটা সময় ছিল যখন সারা সপ্তাহ আমি ডিপ্রেশনে ভুগতাম। তোমাকে বলেও কোনও লাভ হয়নি। এখন অমল আছে বলে দিনগুলো আমার দিব্যি কেটে যায়। সুতরাং অমলের ইচ্ছে আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট।'

'ফাইন! অমলের ইচ্ছে তোমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট কিন্তু আমার ইচ্ছের কোনও দাম নেই, তাই না?'

'সে দাম তো আমি দিয়েছি অর্জুন। বাট ইন এক্সচেঞ্জ, আই গট মোনটনি, মেলানকলি অ্যান্ড ডিপ্রেশন ওনলি। ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু গো ব্যাক টু দ্যাট নাইটমেয়ার এগেইন?'

'ইয়েস আই ওয়ান্ট ইউ টু গো ব্যাক টু দ্যাট নাইটমেয়ার এগেইন। আই উইল নট লেট অমল ট্রেসপাস ইন টু মাই পারসোনাল লাইফ।'

'পারসোনাল লাইফ! ডু ইউ হ্যাভ এনি পারসোনাল লাইফ অর্জুন? ইভন আ বন্ডেড লেবার লিড আ বেটার লাইফ দ্যান ইউ। একটা কথা শুনে রাখো অর্জুন। তুমি আমার মনটাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিয়েছ। অমল না থাকলে আমি বোধহয় পাগলই হয়ে যেতাম। তুমি তোমার কেরিয়ার নিয়ে থাকো। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।'

আর বেশি কথা না বাড়িয়ে রুরু আমার সামনে থেকে চলে গেল। আমি একলা দাঁড়িয়ে রইলাম হতভম্বের মতো।

(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ