রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

 


   রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ৩১        


 


সন্দীপ চক্রবর্তী


কলম্বো
শ্রীলংকা
অর্জুনদা,
আজ ঠাট্টা ইয়ার্কি করার মুড একেবারে নেই। সকাল থেকে মনটা পিঁপড়ের মতো গর্তে লুকোতে চাইছে। এখানে দিন শুরু হয়েছে চমৎকার একটা ছবির মতো। সময় ভালো হলে বারান্দার কোণে রোদ্দুরের ঝিলিমিলিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা যেত। কিন্তু আমার মনে দুশ্চিন্তার পাহাড়। কী খবর দিলে বলো দেখি! তোমার কলিগ করোনা সংক্রমণে মারা গেছেন শোনা ইস্তক তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তা বেড়ে গেছে। মাস্ক ঠিকমতো পরছ তো? এন নাইনটি ফাইভ মাস্ক পরবে। একটা হেড গার্ড কিনে নেবে। দশ মিনিট অন্তর হাত ধোবে। নয়তো হাত স্যানিটাইজ করবে। একটা অক্সিমিটার কিনে নেবে। শরীরের অক্সিজেনের স্যাচুরেশন যেন নব্বইয়ের নীচে না নামে। টেম্পারেচার নিরানব্বই হলেই ডাক্তার দেখাবে। আমার কথাগুলো হালকা ভাবে নিয়ো না অর্জুনদা। বড্ড ভয় করে। আগে আমি এরকম ছিলুম না। বেশ গামা পালোয়ানের মতো হাতের গুলি ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতুম। তখন তো হারাবার মতো কিছু ছিল না। এখন তুমি আছ। তোমার কাছে যাওয়ার স্বপ্ন আছে। এত এত মৃত্যু পেরিয়ে তোমার কাছে যাব কী করে বলো তো? মাঝখান থেকে এরকম না হয়, ঘর বলো সংসার বলো--জীবন সব সাজিয়ে রাখল কিন্তু আমি পৌঁছতেই পারলুম না। সারা জীবন পৃথিবীর কোনও কোণে একলা দীর্ঘশ্বাস ফেলার চুক্তিতে সই করে জুজুবুড়ি হয়ে বসে রইলুম। ঘাটের নৌকো ঘাট থেকেই ফিরে গেল। এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে বেরিয়ে তার কাছে গিয়ে বলতে পারলুম না, তুমি আমার জন্যেই এসেছ। তা হলে আমাকে না নিয়ে চলে যাচ্ছ কেন?
মরণ নিয়ে তোমার মতো কাব্যি করার সাধ্যি আমার নেই। আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি প্যান্ডেমিকের দিনগুলোতে একটু বুঝে-সমঝে চোলো। মাস্ক না পরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ো না। জ্বরজারি কিছু হলেই আমাকে ফোন করবে। বলে দেব কী করতে হবে। এত বড়ো পৃথিবীতে দু'জন আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট অর্জুনদা। একজন তুমি, আর একজন আমার মা। মায়ের জন্যেও খুব চিন্তা হয়। কলকাতায় একা থাকে। ইনফেকশন হয়ে গেলে কী যে হবে কে জানে! কাল ফোন করেছিলুম। মা বলল সন্ধ্যের পর থেকে নাকি আজকাল প্রায়ই মাথা ধরে থাকে। শুনে আমি তো ভয়ে মরি। কিন্তু এত দূর থেকে আমি করবটা কী! ইনফেকশন হলে মা'কে হয়তো সাধারণ চিকিৎসাটুকুও দিতে পারব না। আমার এত আদরের মা, এত প্রিয় মা--একা একা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। আজকাল মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। অসম্ভব রাগ হয়। এই অন্ধকার কি আর কাটবে না? আর কতদিন আমরা পেত্নির মতো শ্যাওড়া গাছের ডাল ধরে ঝুলে থাকব? যতদিন জীবনের কাছে কিছু পাইনি ততদিন না-পাওয়ায় অভ্যস্ত ছিলুম। জীবনের শোকেসে হরেক রকমের জিনিসপত্তর দেখতুম আর মনে মনে দুচ্ছাই করে ফুটপাতের ভিড়ে হারিয়ে যেতুম। হ্যাংলাপনাও ছিল না, কাঙালপনাও না। কিন্তু তোমার মনের নাগাল পাওয়ার পর থেকে আমার মন সর্বক্ষণ হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে। এখন আমি তোমাকে চাই, মা'কে চাই। তোমাদের ভালোবেসে আর সুখী করে সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চাই কুমু পাগলি হলেও ভালোবাসতে পারে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলতে চাই, এই তো তোর ইকড়িমিকড়ি কপালে কী সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। এমন দুখজাগানিয়া জ্যোৎস্নায় তুই আয়নাকে রবি ঠাকুরের কোন গানটা শোনাবি? আমি জানি তুমি কোন গানের কথা বলবে। মায়ের পছন্দও জানি। কিন্তু আয়নাকে আমি তোমাদের পছন্দের গান শোনাব না। আমি গাইব, ও চাঁদ চোখের জলে লাগল
জোয়ার। চোখের জল ছাড়া কি আনন্দের উদযাপন হয় অর্জুনদা? রাধাকে দেখো। মীরাকে দেখো। রবীন্দ্রনাথের গানে দেখো। সব জায়গায় পরমতম আনন্দের প্রকাশ কান্নায়। এই মৃত্যুহিম দিনগুলো আমাকে যে কাঁদতেও দেয় না। সারাক্ষণ শুধু এক চাপা টেনশনে আচ্ছন্ন করে রাখে। এর থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই?
সরি অর্জুনদা। আজ আমি একটু বেশি মাত্রায় ভুলভাল বকছি। মনের ব্যামোর ডাক্তার হয়ে নিজের মনকে বশে রাখতে পারি না, এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে! আসলে এখানকার খবরও ভালো না। সাবিত্রী আম্মা দু'দিন ধরে জ্বরে প্রায় বেহুঁশ। কাল সকালে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমার আর জয়ারও করোনা টেস্ট হয়েছে। এইমাত্র রিপোর্টটা পেলাম। আমরা দুজনেই নেগেটিভ। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে সাবিত্রী আম্মার কাছে। এতদিন এ দেশে আছি, মুহূর্তের জন্যেও মানুষটা আমাদের মায়ের অভাব টের পেতে দেয়নি। এটা খাব ওটা খাব বলে কত অত্যাচারই তো করেছি। হাসিমুখে সব সহ্য করেছেন আম্মা। জানি না আম্মা সুস্থ হয়ে ফিরবেন কিনা। জানি না আর কখনও ঘরের দরজা খুলে কালো মুখের ছোট্ট কপালে বড়ো লাল বিন্দিটা দেখে সূর্যোদয়ের খবর পাব কিনা। এসব কথা যত ভাবি মায়ের কথা তত মনে পড়ে। দু'বেলা কথা হয়। কিন্তু ফোনের কথাই কি সব? মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ল্যাভেন্ডার সাবানের গন্ধটা বুক ভরে না নিলে আর কী হল! কয়েক কোটিবার শোনার পরেও মায়ের কোলে শুয়ে ছোটবেলার দুষ্টুমির গল্পগুলো আরেক বার শুনতে চাওয়ার বায়না না করলে আর কী হল!
আজকের লেখাটা আর বড়ো করব না অর্জুনদা। মন চাইছে বারান্দায় যেতে। এই সময় কলম্বো পোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজগুলো ভারী মন কেমন করা গলায় ডাকে। কেউ সাড়া দেবে না জেনেও ডাকে। আমি মনে মনে সাড়া দিই। একা একাই সাড়া দিই। বেশ একটা দেশে ফিরছি দেশে ফিরছি রকমের অনুভূতি হয়। এখন তো এই ছলনাই সার, তাই না?
ভালো থেকো
কুমুদিনী
( ক্রমশ )

মন্তব্যসমূহ